গল্প

ভাব

মজিদ সাফি

লম্বা একটি ঘর।  দুপাশে বসার ডেস্ক ও চেয়ার আর মাঝে দিয়ে যাতায়াতের জায়গা।  শেষের দিকের ডেস্কে অংশু, সৃজন ও আকাঙ্ক্ষা একত্রিতভাবে বসে কাজ করে।  আজ অনেক কাজ! একটানা কাজ করে ক্লান্ত ।  দুপুরের টিফিন সময়ও পেরিয়ে গেছে।  টিফিন করে বিশ্রাম নেওয়ার মতো করে অংশু সামনের দিকে পা বাড়িয়ে চেয়ারে বসে কিছু ভাবছে, আকাঙ্ক্ষা ইয়ারফোন কানে দিয়ে গান শুনছে, সৃজন জল খেয়ে  বসবে এমন সময় শান্ত স্বভাবের বড়বাবুর হাক , ' কী করছো তোমরা...?'  

শান্ত স্বভাবের সৌখিন বড়বাবুর আসার গতি দেখে এবং উচ্চস্বর  শুনেই অংশু বিচলিত না হয়ে, বুক পকেট থেকে সিগারেট বের করে হাতে ধরে থাকে।  

তোমরা বলে সকলকে সম্বোধন করলেও, এসে অংশুর দিকেই তাকিয়ে খুটির মতো দীর্ঘ বড়বাবু দাঁড়ায়।   

ক্লান্ত অংশু চেয়ারে বসে থেকেই সিগারটি বড়বাবুর দিকে বাড়িয়ে দেয় ।  

টেবিলের ওপাশে অংশুর বিপরীতে সৃজনের পাশের ফাঁকা চেয়ারটি বড়বাবু এক টানে টেনে বসে- 'চলো বাইরে যাই।'

 'এখানেই খাও; কোন সমস্যা নেই।  বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে না।

সিগারেটটি মধ্যমা ও অনামিকা আঙ্গুলের ফাঁকে নিয়ে মুঠো করে ডান হাতটা  অংশুর দিকে বাড়িয়ে দেয়।  বিরক্তি নিয়ে সে প্যান্টের পকেট থেকে, গ্যাস লাইটারটি বের করে সিগারেট ধরিয়ে দেয়।  নেশায় বড়বাবু সঙ্গে সঙ্গে একটান দিলো।  ধোঁয়া মুখের মধ্যেই কয়েক সেকেন্ড রাখলো।  তারপর নাক ও মুখ দিয়ে অল্প অল্প করে ধোঁয়া ছাড়লো।  এতক্ষণে যেন তিনি  শান্তি পেলেন।  বাঁ হাতের মোবাইলের লকটি, ডান হাতে বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে খুলে, পজ করে রাখা ফেসবুকের খবরটি প্লে করে দিয়ে শান্তভাবে শুনতে থাকে।     

বছর পঞ্চাশের বড়বাবু সচ্ছল পরিবারের একমাত্র ছেলে।  কলকাতার নামিদামি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াশোনা ।  ক্লাসে বরাবরই ফার্স্ট বয় ।  অফিসের বিভিন্ন ইংরেজি নোট লেখায় খুব দক্ষ।  তা নিয়ে তিনি নিজেই সবার সামনে খুব গর্ব প্রকাশ করেন।  সে দক্ষতা দেখানো আর জানানোর জন্যই সবার সাথে ফ্রেন্ডলি মেলামেশা করেন।  

'বুঝেছ অংশু, যেভাবে সবকিছুর মূল্যবৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে এই টাকায় আর সংসার চালানো দায়।' 

আকাঙ্ক্ষা সাথে সাথে কান থেকে ইয়ারবার্ড দুটি খুলে হাতের ধরে।  চশমার ওপর ফাঁক দিয়ে দেখার মতো করে বড়বাবুর দিকে চেয়ে দেখে।  তারপর না শোনার মতো করে মোবাইলে চোখ রেখে আগ্রহ নিয়ে বড়বাবুর কথা শুনতে থাকে।  

'হুম দাদা ! কলকাতায় নিজের বাড়িতে থেকে ৬৫-৭০ হাজার টাকা দিয়ে, আপনার তিনজনের একটি সংসার চলছে না।  আর কলকাতায় ভাড়া বাড়িতে থেকে ৩৫ হাজার টাকায় আমার দুটি সংসার কিভাবে চলছে, বলতে পারেন!'  

'এই রাজ্যের চোর সরকার মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেবে? সব টাকা খেয়ে চুপচাপ।  এদিকে আমাদের কোন ডিএ নেই আর ওই দিকে কেন্দ্র ৫০ শতাংশ হারে দিয়ে দিচ্ছে।' পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে, আমাদের সামনে একটু থেমে গিয়ে রুদ্রদা বলল।

 

বোঝাই যাচ্ছে পিছনের  ডেক্সে বসে থাকা সকলেই আমাদের কথা শুনছেন।  রুদ্রদা শুধুমাত্র তাঁর নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকেন।   মাথা নিচু করে, যেন কিছু একটা খুঁজার মতো করে, সবসময় বিড়বিড় করতে করতে  চলাফেরা করেন।   

'রুদ্রদা, গোটা দেশব্যাপী রাজ্য ও কেন্দ্র মিলিয়ে সরকারি কর্মচারী মাত্র তিন শতাংশ।  বাকি কৃষক, শ্রমিক, কন্ট্রাক্টচুয়াল কর্মচারী, বেসরকারি কর্মচারী, অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মচারী তাদের কী হবে? দ্রব্যমূল্য তো তাদের ক্ষেত্রেও বাড়ছে।'- চেয়ারে বসে সৃজন রুদ্রদাকে জিজ্ঞাসা করল।  রুদ্রদার কথা বলার ক্ষেত্রে জড়িয়ে যাওয়ার সমস্যা আছে।  কিন্তু এই প্রশ্নে জড়ানো আরো বেড়ে যায়।  অনুচ্চস্বরে কি একটা বলে! সবটা শোনা যায় না, শুধু শোনা যায় - 'আমরা খেতে... '। কাজেই নিজেকে ব্যস্ত করে নেয় আর বিড়বিড় করে।

বড়বাবু চেয়ারটি সৃজনের দিকে ঘুরিয়ে নেয়।  হাত দুটি চেয়ারের হাতুলের ওপর অসহায়ের মতো ছড়িয়ে দেয়।  হাতুলে হাতের তালু দিয়ে বুলিয়ে দু'বার চেয়ারের হাতুলের মাথায় মেরে বলেন, ' সৃজন এই টাকায় আর সংসার চলে না! সমস্ত ওষুধের দাম অনেক বেড়ে গেছে।  আর আমার বেতনের অনেকটাই তো এই ওষুধেই চলে যায়।'

আকাঙ্ক্ষার হঠাৎ কথা শোনার আগ্রহ উবে গেল।  ইয়ারবাড দুটি কানে গুঁজে, মোবাইলের ভলিয়ম বাড়িয়ে মোবাইল দেখতে থাকে।

রুদ্রদা ফাইল হাতে ঘরেই পায়চারি করেছে।  তার মধ্যে কিছু বলার প্রচণ্ড অশান্তি কাজ করেছে।  পা তুলে তুলে না হেঁটে মেঝে ঘর্ষণ করে হাঁটছে।  যার ঘসঘস শব্দেই তার যাওয়া-আসার গতি ও দিক স্পষ্টতই নির্দেশ করছে।  ফাইলটি নিয়ে কি করবে বুঝতে পারছে না।

পায়চারি করতে করতে বড়বাবুর পাশে এসে দাঁড়ায়।

সপ্রশ্নে সৃজন রুদ্রদার দিকে তাকাতেই রুদ্রদা কোনো এক অতৃপ্তিতে স্বাভাবিকের থেকে দ্রুতগতিতে বলেন , 'আমাদের বাড়ির আশপাশের রাজমিস্ত্রির শ্রমিকরা মজুরি অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে।  তুমি সেটা জন্য?'

'শুধু রাজমিস্ত্রির শ্রমিকদের দৃষ্টান্ত দিলেন।  আর সেটা আপনার সাপেক্ষে কত শতাংশ বাড়িয়েছে? সেটা ভেবে দেখুন তো। আর আপনার বাড়ির কাজের মাসির বেতন, প্রচণ্ড গরমে-শীতে- বর্ষায়-মাতৃত্বকালীন ছুটি কত বাড়িয়েছেন? কৃষক, শ্রমিক, কন্ট্রাক্টচুয়াল কর্মচারী, বেসরকারি কর্মচারী, অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মচারীদের কথা তো বললেন না?, রুদ্রদা যতটা অতৃপ্তিতে এবং  দ্রুতগতিতে বললেন, ঠিক ততোটাই শান্তভাবে সৃজন বলল।

প্রশ্নে রুদ্রদা অনুচ্চারিতভাবে কিছু বলে চলে যায়। যার কিছুই কারোর কান পর্যন্ত পৌঁছয় না। বর্তমানে দেশের সমস্ত নিউজ চ্যানেলগুলো মূলত কর্পোরেট ও রাষ্ট্র নেতাদের তল্পিবাহক হয়ে দিনরাত যে প্রোপাগান্ডা চালিয়ে নাগরিকের কানে মধু ঢালছে, সেই ডোপ না পেয়ে তার অতৃপ্তি আরো বেড়ে গেলো।  

কথায় সুখ না পেয়ে বড়বাবু পা দুটিকে সামনের দিকে এতটায় প্রসারিত করে, বিপরীতে বসে থাকা প্রীতির খুলে রাখা জুতো দুটি পায়ে লেগে সরে যায়।  হাত দুটি আবার চেয়ারের হাতুলের ওপর দু'বার ধপ ধপ করে ফেলে, 'চাষিরা দাম পাচ্ছে না তো শাক-সবজির দাম এত বাড়ছে কেন? অবশ্যই সঠিক দাম পাচ্ছে।'

অবাক হয়ে সৃজন ভাবে, এই শিক্ষিত মানুষগুলোও যদি এইধরনের প্রশ্ন করে, তাহলে অন্যরা কি করবে! বিস্মিত সৃজন চেয়ারটি ঘুরিয়ে নিয়ে বড়বাবুকে জিজ্ঞাসা করে, ' আচ্ছা বড়বাবু, এই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে প্রশাসনকে কখনো কৃষকদের বাড়িতে তল্লাশি করতে দেখেছেন?'

'না.. তা দেখিনি...', অবলীলায় উত্তর দেয়।

উত্তরের অপেক্ষা না আবার সৃজন বলতে শুরু করে, 'শিল্পপতিরা, তাদের উৎপাদিত দ্রব্যাদির মূল্য, নিজেরাই নির্ধারণ করতে পারে।  কিন্তু কৃষকরা কি তাদের উৎপাদিত ফসলের মূল্য নিজেরা নির্ধারণ করতে পারে? পারে না।  তাহলে কারা এই শস্যের মূল্য নির্ধারণ করে?

বড়বাবুর মধ্যে অসাড়তা নেমে আছে।  এসব কথার মাথামুণ্ড সে কিছুই বুঝতে পারছে না।  সবই তার মাথার ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে।  শুধু সৃজনের দিকে মোটা ফেমের বিজ্ঞ চশমা চোখে চেয়ে আছে।

সৃজন আবেগপ্রবণ হয়ে ভারী গলায় আবার বলতে শুরু করে, কৃষকদের সেই উৎপাদিত ফসলগুলো কর্পোরেটরা ও মধ্যবর্তী দালালরা হাইজ্যাক করে।  হ্যাঁ ।  হাইজ্যাকই বলছি।  কারণ এত স্বল্পদামে  তাদের ফসলগুলো কেনা হয়! এর থেকে ভালো শব্দ ব্যবহার না করাই ভালো।  তার কিছু ফসল প্রক্রিয়াজাত করে আর বাকি শস্য কৃষকদের থেকে কেনা দামের তিনগুণ চার গুণ বাড়িয়ে মূল্য নির্ধারণ করে, সরাসরি বাজারজাত করে। এই চিত্রের ব্যাপ্তি শুধু আমাদের রাজ্যে নয়, গোটা দেশ তথা সমগ্র পৃথিবীব্যাপী একই চিত্র।

বড়বাবু  আলোচনার বিষয়ে আর মনোযোগ দিতে পারছেন না।  পা দু'টি ভাঁজ করে বসে।  চোখের দৃষ্টি তার মোটা পেটের দিকে ঘুরে যায়।  হাত দুটিও চেয়ারের হাতল থেকে নামিয়ে উরুদয়ের উপর রাখে।  ডান হাত দিয়ে বাম হাতের মধ্যমা ও অনামিকার  নীল ও লাল পাথর বসানো সোনালী রঙের আংটি দুটি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আঙ্গুল দুটি পরিষ্কার করছে। 

সৃজন আলোচনা আর বাড়ায় না।  মিনিট দুয়েক নীরব থাকে।  তারপর শান্তভাবে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়।  টেবিলের ওপর থেকে বোতলটি নিয়ে ছিপি খুলে ঢক ঢক জল পান করে।  আবেগে তখনো সে কিছুটা উত্তেজিত! স্বাভাবিক হওয়ার জন্য চেয়ার থেকে উঠে বড়বাবুর পেছন দিয়ে বেরিয়ে ঘরেই পায়চারি করতে শুরু করে।

'সৃজন, দাঁড়া....এই চেয়ারে বস।  অনেকক্ষণ থেকে তোদের কথোপকথন শুনছি.... ', সৃজনের পেছনে চার নম্বর ডেস্কের দিদি খাতায় লিখতে লিখতে বলল।

 

সৃজন তখনো স্বাভাবিক হয়নি।  তার মধ্যে একটা উত্তেজনা কাজ করছে।  কলিগদের মনোভাবের এই ছিরি দেখে তার মধ্যে ইরিটেশন কাজ করে- তাই নিয়েই এই উত্তেজনা।

'কেন বৃদ্ধি পায়? বলতো।' লিখতে লিখতে দিদি বলে।

'তুমি, দাম কেন বৃদ্ধি পায় জানতে চাইছো? নাকি কোনো ফসলের দাম, কিভাবে নির্ধারিত করা দরকার? তা জানতে চাইছো?' তখনো আবেগে সৃজনের জ্বিভ জড়িয়ে যাচ্ছে।

 'একটু থাম।  হাতের কাজটা শেষ করে নিই।' বলে দ্রুত লিখতে থাকে।

সৃজন টেবিলের  ওপরের বোতলটি নিয়ে, তিন-চার ঢোক জল পান করে, নিজেকে স্বাভাবিক করার আপ্রাণ চেষ্টা করে।

দিদি হাতের কাজটি শেষ করে, খাতা বন্ধ করে দেয়।  গোলাপি ফেমের চশমাটি চোখ থেকে খুলে, টেবিলের ওপর খট করে রেখে চোখে চোখ রেখে- ' এবার বল।'

'কোনটি বলবো?'

'দুটোই বল'।

কুনই ভাঁজ করে টেবিলের ওপর ভর দিয়ে, একটু থেমে, আসতে করে গলা খেকারী দিয়ে বলে, 'ধান উৎপাদনের কথাই ধরা যাক, ধান উৎপাদের জন্য প্রয়োজন-  জমি, ধানের বীজ, শ্রমিক, ধানের জমির ফোঁড়ার জন্য ট্রাক্টর, জমির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য রাসায়নিক সার, কীটনাশ, ধানের জমিতে জল দেওয়ার জন্য ডিপওয়েল, কীটনাশক স্প্রে মেশিন, মাঠ থেকে ধান আনার জন্য গাড়ি, ধানঝাড়া মেশিন ইত্যাদি।  ধান চাষের জন্য জমি প্রস্তুত, ধান বপন , আগাছা পরিষ্কার, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক স্প্রে , ধান কাটা, ধান শুকানো, বাড়ি নিয়ে আসার জন্য, ধান ঝাড়া, ঝাড়া ধান শুকানো, স্টোরেজ প্রভৃতি কাজে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক লাগে তার খরচ। এছাড়াও প্রায় চার মাস ধরে ধানের চাষের ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় কৃষকসহ তার পরিবারের অন্যান্য সহযোগী সদস্যদের শ্রমমূল্য এর সঙ্গে যুক্ত হবে।

 ' যুক্ত হবে কেন?' কলম থামিয়ে সৃজনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে।

এই যে তুমি প্রতিদিন খেয়ে-দেয়ে, পরিষ্কার পোশাক-আশাক পড়ে, সুস্থভাবে অফিস আসতে পারছো, তার জন্য তুমি বাড়িতে একটি বা দুটি কাজের মাসি রেখেছ।  সে তোমার ঘর-বাড়ি পরিষ্কার করছে, পোশাক-আশাক পরিষ্কার করে দিচ্ছে, খাবার প্রস্তুত করে দিচ্ছে।  তাঁর জন্য তোমাকে প্রতিমাসে তোমার বেতনের একটা অংশ তাঁকে পারিশ্রমিক হিসেবে দিতে হয়।  এই কাজগুলো তো কৃষকের পরিবারের কেউ না কেউ করে।  সাথে ওই বিপুল সংখ্যক শ্রমিকের খাবার প্রস্তুত করে।  একজন কৃষক কি এককভাবে সব কাজগুলো করে উঠতে পারবে? কাজেই তাঁদের পারিশ্রমিক শ্রম কৃষকের উৎপাদিত ফসলের মূল্যের মধ্যেই নিহিত থাকবে।

বিষয়টি ভেবে,'হুম!' , হঠাৎ কোন কিছু পেয়ে গেলে যেমন হয় তেমনভাবে  মাথা ও শিরদাঁড়া সোজা করে বলে, 'কিন্তু, স্প্রে মেশিন- ট্রাক্টর- গাড়ি -ধানঝাড়া মেশিন এগুলো তো প্রতিবছর কিনতে হয় না।  একবার কিনলেই তো হয়ে যায়।'

'হ্যাঁ। সেগুলো একবারই কিনতে হয়।  তার জ্বালানি-মেরামত-ইন্সুরেন্স বাবদ খরচ- তাঁকে সবসময়ই বহন করতে হয়।  এসবের পরেও কিন্তু তার একটা নির্দিষ্ট আয়ু রয়েছে! সেই আয়ুর পরে, সেগুলোও অচল হয়ে পড়ে।  তার জন্য তো তাকে এককালীন মোটা অংকের টাকা খরচ করতেই হয়।....'

'হুম! তা করতে হয়।  সেটা ঠিক ', গরম শ্বাস ছেড়ে  শিরদাঁড়া শিথিল করে বলে।

সৃজন বিরত না নিয়ে বলে চলে, 'তাহলে আমরা কিভাবে মেশিন-মূল্য হিসাব করবো? না, মেশিনের গড় আয়ু দিয়ে কাল সাপেক্ষে মেশিনের মূল্যকে ভাগ করে যা দাড়ায় তাই তার মূল্য।'

কঠিন জটিলতার মধ্যে পড়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে, 'সেটা আবার কেমন?'

'ধরুন, সেচের জন্য সেচ মেশিন কেনা হল।  যার বর্তমান দাম 60000 টাকা।  মেশিনটির কার্যকারী ক্ষমতার আয়ু ২১ বছর, অর্থাৎ 21x12 = 252 মাস। 60000÷252= 238 টাকা প্রতি মাসে। ধান চাষ করতে গড়ে সময় লাগে তিন মাস। অর্থাৎ 3x238=714 টাকা।  অবশ্য এর সাথে সময় সাপেক্ষে টাকার দাম বৃদ্ধি পেলে খরচও বেড়ে যাবে।'

দিদির পাশের ডেস্কের অফিসার ফাইল থেকে চোখ তুলে হঠাৎ করে বলতে লাগলো, 'আমাদের গ্রামের চাষিরা, তাদের উৎপাদিত ধান বপন করেই ধান চাষ করে।  তা র জন্য আলাদা করে দাম ধরার কি দরকার আছে?'

সৃজন অফিসারের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে 'সে অনেক আগের কথা স্যার... বর্তমানে ধানের বীজ কিনে বপন করতে হয়।  তাদের উৎপাদিত ধানের বীজ থেকে ধানের চারা হয় না।  কারণ বর্তমান ধান হচ্ছে বন্ধ্যা।  আগে চাষিরা তাদের উৎপাদিত পছন্দসই ধান বপন করত।  একাধিক ধরনের ধান চাষ করত।  কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন কর্পোরেট, সাথে রাষ্ট্রনেতা ও কর্পোরেট পুঁজির তল্পিবাহক রক্ষণকামী মেরুদন্ডহীন, লোভী, স্বার্থপর বিজ্ঞানী, জলবায়ুবিদ, মৃত্তিকাবিদ, অর্থনীতিবিদ সকলে সম্মিলিত ভাবে তাদের প্রক্রিয়াজাত বীজ কৃষকদের উচ্চ ফলন ও বেশি লাভের প্রলোভন দেখিয়ে বাজারজাত করে কৃষকের স্বাধীন ও দেশীয় বীজ ভান্ডার  একপ্রকার ধ্বংস করে দিয়েছে।  চাষিরা ভুলেই গেছে তারা নিজেদের উৎপাদন করা সুস্বাদু ধানের বীজের কথা।'  

ফাইলের মধ্যে চোখ রেখেই একজন অফিসার ইংরেজিতে কী যেন একটা বলেন, সেটা বুঝে উঠতে না উঠতেই আবার বাংলায় বলে, 'এত কিছু জেনে, হিসেব কষে কি চলা যায়?'  

'এটা হচ্ছে রাক্ষিক সমাজের চাপিয়ে দেওয়া কথা।  যার মাধ্যমে রক্ষ ব্যক্তির জানার স্পৃহাকে ছোট করে দেয়।  এত কিছু  জানার প্রতি ব্যক্তি মানুষের অনীহা আর কর্পোট ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার তা জনসাধারণকে জানানোর প্রতি অনীহার মধ্যেই রয়েছে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে ধোঁয়াশার মূল!    

কারো চোখে মুখে কোন প্রকার ভাবান্তর দেখতে পাওয়া গেল না।  কেউ আর কথা বাড়ালো না।  সকলে আবার কাজে মন দিল।  সৃজন ধাতস্থ হয়ে এদের সাথে সংলাপের অসারতা উপলব্ধি করলো।  যদিও সে এটাও জানে যে কানের কাছে অসার কথার কাউ কাউ বাজতে থাকলে কখনও কখনও জবাব দিতে হয়!

:: ভয়েস মার্ক ::

- দ্বি-মাসিক পত্রিকা -

সম্পাদক: মোঃ আযাদ হোসেন

গ্রাহক পরিষেবা: রনিক পারভেজ, ৯৩৭৮৪৮০১৯১

পাণ্ডুলিপি (ম্যানুস্ক্রিপ্ট) প্রস্তুতি ও সম্পাদনা : মোঃ মিনারুল হক

নামলিপি ও প্রচ্ছদ চিত্র: হিমাদ্রী শেখর মজুমদার

সত্বাধিকার: ভয়েস মার্ক কালচারাল গ্রূপ

RNI Ref. Number: 1343240

-: যোগাযোগ :-

সম্পাদকীয় দপ্তর:
ভগবানপুর , আষাঢ়িয়াদহ
লালগোলা, মুর্শিদাবাদ
পিন - ৭৪২১৪৮

azadm.1981@gmail.com, voicemark19@gmail.com

:: সামাজিক মাধ্যম ::