হালিম সর্দার
সালটা ছিল ২০১৯। রমেশ ও তার কয়েকজন বন্ধু মিলে ভর্তি হয় একটি কোচিং সেন্টারে। রেলওয়ের NTPC পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য। সেখানেই রমেশের পরিচয় হয় রাকেশ মণ্ডল এর সাথে। রাকেশ মুসলিম। তার বাড়ি নদিয়ার বেলেদা গ্রামে। পরিচয় হওয়ার কিছুদিন পর জানা যায় সে পরিবারের মেজো সন্তান। তার দাদা নিজের পছন্দের মেয়ে বিয়ে করে অনেক দিন থেকে আলাদা থেকে। তার ছোট বোন ক্লাস নাইনে পড়ে। মা গৃহিনী , তিনি সুগারের রোগী। বাবা মহারাষ্ট্রের একটি সাবান কারখানায় শ্রমিকের কাজ করে । বংশের দিক থেকে ফার্স্ট জেনারেশন লার্নার সে।
রাজেশ ছিল শ্যাম বর্ণের এবং মেধাবী ছাত্র। তার স্বপ্ন ছিল রেলওয়েতে চাকুরি করে পরিবারের অভাব ঘুচাবে। এজন্যই সে বন্ধুদের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে কোচিংএ ভর্তি হয়। যথারীতি চলতে থাকে সকলের প্রস্তুতি । কিছুদিন পর কোচিং এ ভর্তি হয় মোনালিসা রায় নামে একটি মেয়ে। ছিপছিপে চেহারার মেয়েটির মুখশ্রী খুব সুন্দর । কোচিং এর প্রায় সব ছেলেরই ক্রাশ ছিল সে। সকলেই চেষ্টা করতো তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে, তার মোবাইল নাম্বার, তার ফেসবুক আইডি নেবার । কিন্তু সে কাউকে পাত্তা দিত না।
তাই রমেশ ও তার কয়েক জন বন্ধু মিলে কোচিং এর অফিস থেকে মোনালিসার ভর্তি ফর্মটা চুরি করে আর সেখান থেকে জানতে পারে মোনালিসা তার পরিবারের একমাত্র সন্তান । তার বাবা রাজ্য পুলিশের এসআই । এটা জানার পরই সকলের মন থেকে ঊরু ঊরু ভাব দূর হয়ে যায়। তার পর থেকেই সকলে মোনালিসা ভয় পেত। এদিকে রাজেশের কিন্তু মোনালিসার প্রতি কোনো আকর্ষণ ছিল না। সে তার পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকত । রাজেশের এই অ্যাটিটিউড এবং তার মেধা মোনালিসাকে আকর্ষণ করতো।
মাঝে মাঝেই মোনালিসা রাজেশের কাছে অঙ্ক ও জি ই বুঝে নিত । এতে অন্য সব বন্ধুর রাজেশের প্রতি রাগ হতো। তার বন্ধুরা বেশ কিছু দিন রাজেশকে এড়িয়ে চলতে লাগলো । যদিও পারে সকলে ভাগ্য কে মেনে নিয়ে আবার আগের মত হোয়ে গেল । মাঝে মাঝেই মোনালিসা রাজেশের টিউশান ফী দিয়ে দিত , বিভিন্ন প্রাকটিস বই কিনে দিত । এসব দেখার পর রমেশ ও তার বন্ধুদের সন্দেহ হয় যে তাদের মধ্যে কোনো প্রেমের সম্পর্ক হয়েছে।
তাই একদিন টিউশন শেষ করে রমেশ তার কজন বন্ধু মিলে রাজেশ ও মোনালিসাকে নিয়ে একটি মাঠে বশে। তাদের মধ্যেকার সম্পর্কের কথা জানতে চাই। তারা কোনো চতুরতা না করেই তাদের প্রেমের সম্পর্কের কথা স্বীকার করে । রমেশ ও তার বন্ধুরা তাদের দুজনকে বোঝাই এই সম্পর্কের পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে ।
তাছাড়া মোনালিসার বাবা পুলিশ ইন্সেক্টর । এই সম্পর্কের কথা জানাজানি হলে মোনালিসার বাবা তোর জীবন শেষ করে দিতে পারে। কিন্তু দুজনের কেউই এই কথাই কর্ণপাত করলো না এবং উঠে চলে গেলো। যথারীতি চলতে থাকলো সকলের প্রস্তুতি। কিছুদিন পর নেমে এলো করোনা মহামারি! আর শুরু হলো লকডাউন । কোচিং বন্ধ হয়ে গেল।
বন্ধ হয়ে গেল রাজেশের বাবার কারখানা । কিছু দিন যেতেই সংসারে দেখা দিল আর্থিক অনটন । এখন রেশনের সামগ্রী তাদের সংসারের একমাত্র খাদ্য। এইদিকে রাজেশের বাবা কর্মহীন হয়ে অবসাদে ভুগতে থাকে। দিন দিন তিনি অসুস্থ হতে থাকেন । একদিন রাতে প্রচণ্ড কাশতে থাকেন। কোনো রকমে একটি গাড়ি ভাড়া করে NRS হসপিটালে ভর্তি করা হয়। ডাক্তার বাবুরা কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করার পর ক্যান্সার অনুমান করেন এবং চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার হসপিটালে ভর্তি করার পরামর্শ দেন।
এখনকার ডাক্তার পরীক্ষা করার পর জানায় বাবার ফুসফুসে ক্যান্সার এবং লাস্ট স্টেজ । এই খবরে পরিবারের উপর আকাশ ভেঙে পড়ে। ডাক্তার জানায় ভর্তি রেখে কেমো দিতে হবে। প্রচুর টাকা দরকার। টাকার প্রয়োজনে আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় কিন্তু কারো কাছ থেকে কোনো সাহায্য না পেয়ে বাধ্য হয়ে রাজেশ সুদের ব্যাবসায়ী গিয়াসউদ্দিন মোল্লার কাছ থেকে ভিটের দলিল জমা দিয়ে টাকা ধার নেই ।
বাবার চিকিৎসা চলতে থাকে । কিন্তু তার পরও বাবাকে বাঁচানো গেলো না। এক মাস পরে রাজেশের বাবা মারা যায়। রাজেশ দিক শূন্য হয়ে পড়ে। এখন কী করবে ভেবে পাই না। এর মধ্য লকডাউন উডে যায় । রাজেশ ও তার কয়েকজন বন্ধু মিলে ঠিক করে তারা একটি মিনি কো অপারেটিভ ব্যাংক খুলবে এবং গ্রামের ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষকে সুদে টাকা ধার দিবে । এর জন্য রাজেশ মায়ের জমানো গায়না বিক্রি করে ও মোনালিসার কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নেয়। তারপর তারা ব্যাংক খুলে ব্যাবসা শুরু করে দেয়।
অল্প দিনের মধ্যেই তাদের ব্যবসা ভালো পজিশন করে নেয়। রাজেশ ধীরে ধীরে গিয়াসউদ্দিন মোল্লার ঋণের টাকা শোধ করতে থাকে । এই দিকে মোল্লার সুদের ব্যবসা ভাটা পড়ে । গিয়াসউদ্দিন মোল্লা হল অত্র এলাকায় জনপ্রতিনিধি ও মসজিদের ক্যাশিয়ার । মোল্লা ষড়যন্ত্র করতে থাকে কিভাবে এই ব্যাংক বন্ধ করা যায়। একদিন মোল্লা রাজেশের বাড়ি গিয়ে তার মাকে হুমকি দেয় "তোমার ছেলেকে বলো এই ধরনের অধার্মিক ব্যবসা বন্ধ করতে আর না হয় আমার ঋণের টাকা ইন্টারেস্ট সহ এখনই পরিশোধ কারো, নইলে আমি তোমাদের ভিটা দখল নেবো।" রাজেশের মা রজেশকে বোঝানোর অনেক চেষ্টা করে কিন্তু রাজেশ তাতে কোনো কর্ণপাত করে না। এদিকে রাজেশ দের ব্যবসা যেমন বাড়তে থাকে তেমনি করে সম হারে বাড়তে থাকে মাল্লার গাত্রদাহ।
কোনো উপায় না পেয়ে গিয়াসউদ্দিন মোল্লা নিজের প্রভাব খাটিয়ে মসজিদের ইমামকে দিয়ে ফতুয়া জারি করে যে , এই ধরনের সুদের ব্যাংক ইসলামে সম্পূর্ণ হারাম এবং এদের কাছ থেকে যারা টাকা নেবে এমনকি যারা এদের সঙ্গে চলাফেরা করবে তারাও হারামের সঙ্গে লিপ্ত থাকবে। এই ফতোয়ার পর ব্যাংকের অবস্থা ধীরে ধীরে খারাপ হতে থাকে । যারা ব্যাংক থেকে টাকা ধার নিয়ে ছিল তাদের মোল্লা টাকা পরিশোধ না করার পরামর্শ দেন। প্রতিবেশীরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেই। এক প্রকার একঘরে হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে রাজেশরা তাদের ব্যাংক বন্ধ করে দেয়। আবার রাকেশ বেকার হয়ে পড়ে। পরিবার আর ঋণের বোঝাই রাজেশ বিসন্ন হয়ে পড়ে।
এখন কি করবে ভেবে পায় না। আর কি করেই বা এত ঋণ শোধ করবে। একদিন সব কিছু মোনালিসাকে খুলে বলে । মোনালিসা সব শোনার পর রাজেশ কে মাজদিয়া স্টেশনে একটা নিরামিষ ভাতের হোটেল দিতে বলে। মোনালিসা আবারো রাজেশ কে পঞ্চাশ হাজার টাকা দেয়। রাজেশ মোনালিশার কথা মত মাজদীয় স্টেশনে নিরামিষ ভাতের হোটেল দেয়। ইউটিউব দেখে খাবার বানানো শিখে রাজেশ । কিছু দিনের মধ্যেই রাজেশের হোটেলের সুনাম ছড়িয়ে আশপাশে ।
এদিকে রাজেশের বোন ২০২৩ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে রানাঘাট কলেজে বাংলা অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়। রাজেশ হোটেলের কাজ শেষে প্রতিদিন রাতে মানালিশাকে প্রতিদিনের কাজের অভিজ্ঞতার শোনাতো। এইভাবে কথা বলার সময় মানালিসার বাবা দেখে ফেলে । মোনালিসাকে প্রচন্ড বকাঝকা করে ।কিন্তু মোনালিসা বাবাকে কিছু বলতে না চাইলে তার বাবা তাকে ভীষণ মারধর করে । ভয়ে মানালিসা সব বলে দেই। মুসলিম ছেলের সাথে প্রেমের কথা শুনে বাবার মাথায় আগুন উঠে যায়। তৎক্ষণাৎ মনালিসার কাছ থেকে মোবাইলটা কেড়ে নেয়। রাজেশ কে শায়েস্তা করার সংকল্প করে । মোনালিসার বাবা রাজেশের পরিবার সমন্ধে খোজ খবর নিতে থাকে । রাজেশের হোটেলের সুনামে আশেপাশের হোটেল মালিকরা রাজেশের প্রতি ঈর্ষান্বিত হতে থাকে । আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মোনালিসার বাবা ও হোটেল মালিকরা রাজেশ কে হত্যার সড়যন্ত্র করে। মানালিসর বাবা পুলিশের ব্যাপারটা দেখে নেবার প্রতিশ্রুতি দেই। কথা মত একদিন রাত্রে সেই হোটেল মালিকরা আর তথাকথিত গো রক্ষা বাহিনীর কিছু সদস্যরা লাঠিসোটা নিয়ে উপস্থিত হয় রাজেশের হোটেলে, গোপনে গো মাংস বিক্রি করার অপবাদে রাজেশ কে হোটেল থেকে টেনে হিচড়ে বের করে প্রচণ্ড প্রহর করে ।
ঘন্টাখানেক পর পুলিশ এসে রক্তাক্ত রাজেশ কে উদ্ধার করে স্থানীয় হসপিটালে ভর্তি করলে ডাক্তার প্রচণ্ড রক্ত ক্ষরনে রাজেশের মৃত্যু হয়েছে বলে জানায় । এই খবরে রাজেশের পরিবারে শোকের ছায়া নেমে আসে । স্বামী ও সন্তান হারিয়ে রাজেশের মা অর্ধ পাগল হয়ে পড়ে।
এদিকে রাজেশের মৃত্যুর দুদিন পরেই সুদখোর, বিপত্নীক ষাটোর্ধ গিয়াসউদ্দিন মোল্লা রাজেশের বাড়িতে উপস্তিত হয় এবং রাজেশের মাকে বলে" এখন তো তোমাদের দেখার কেউ নাই , এত কিছুর পরও তোমার বড় ছেলে কোনো খোজ নেইনি । তোমাকে একটা ভালো যুক্তি দিই তুমি তোমার মেয়ের সাথে আমার বিয়ে দিয়ে দাও , তোমার মেয়ে রানীর মতো থাকবে আর তুমিও থাকবে আমার বাড়িতে । আর যদি তুমি আমার এই প্রস্তাব গ্রহণ না কর, ঋণের দরুন আমি এই ভিটে দখল করবো। ভাবার জন্য আমি তোমাকে এক সপ্তাহ সময় দিলাম।"
এই বলে মোল্লা চলে যায়। রাজেশের মা অনেক ভাবার পর কোনো উপায় না পেয়ে মেয়ের সাথে মোল্লার বিয়ে দিয়ে দেয়। মাস না যেতেই মোল্লা ভিটে তার নামে লিখে দেবার জন্য স্ত্রীর উপর অত্যাচার শুরু করে । মেয়ের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে রাজেশের মা গিয়াসউদ্দিন মোল্লার নামে ভিটে লিখে দেই । কিন্তু তার পরও চলতে থাকে অত্যাচার। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে রাজেশের বোন গলাই দড়ি লাগিয়ে আত্মহত্যা করে। এর পর রাজেশের মা পুরোই পাগল হয়ে একদিন কোথায় যেনো হারিয়ে যায়। তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
গোটা কাহিনির সাক্ষী ছিল রাজেশদের গ্রামের পুব পাড়ের দুশো বছর পুরনো বটগাছটি। এক সন্ধ্যায় অফিসের কাজ থেকে ফিরে ওই গাছের কাছে বসেই বৃত্তান্তটি আমি জানতে পারি। বর্ণনা বা তথ্য বিভ্রান্তির দায় যদি কাউকে দিতে হয় তো সেই বুড়ো গাছটিকে দিতে পারেন। অবশ্য গিয়াসুদ্দিনরা তাকেও আর বাঁচিয়ে রেখেছে কিনা সে খবর এ-শর্মার জানা নেই!
- দ্বি-মাসিক পত্রিকা -
সম্পাদক: মোঃ আযাদ হোসেন
গ্রাহক পরিষেবা: রনিক পারভেজ, ৯৩৭৮৪৮০১৯১
পাণ্ডুলিপি (ম্যানুস্ক্রিপ্ট) প্রস্তুতি ও সম্পাদনা : মোঃ মিনারুল হক
নামলিপি ও প্রচ্ছদ চিত্র: হিমাদ্রী শেখর মজুমদার
সত্বাধিকার: ভয়েস মার্ক কালচারাল গ্রূপ
RNI Ref. Number: 1343240
সম্পাদকীয় দপ্তর:
ভগবানপুর , আষাঢ়িয়াদহ
লালগোলা, মুর্শিদাবাদ
পিন - ৭৪২১৪৮
azadm.1981@gmail.com, voicemark19@gmail.com