নাসিরা খাতুন
গ্রীষ্মের দাবদাহ। বাইরে লু বইছে। কুকুরদের জিভের লালা শুকিয়ে গেছে। তারা রাস্তার ধারে গাছতলায় বসে জিভ বের করে ধুঁকছে। হাসপাতাল থেকে ডিউটি সেরে স্নান করে জাহেদা জানালার কিছুটা অংশ খুলে খোলা চুলে বিছানার উপর বসে। জাহেদার মা নার্সের চাকরি করতেন। জাহেদা যখন পেটে তখন তার মায়ের মুখে ঘা হয়েছিল সেই ঘা আর ভালো হয় নি। কত ডাক্তার, কোনো ওষুধে কাজ হয় নি। জাহেদার বয়স যখন আঠারো বছর তখন ডাক্তার জবাব দিলেন। ঘা একসময় ক্যান্সারে পরিনত হল। কেমো থেরাপির তিন বারের বেলায় মা মারা গেলেন।
মায়ের মৃত্যুর বছর চারেক পর জাহেদা চাকরিটা পায়। জাহেদার স্বামী কোচবিহারে একটি বেসরকারি স্কুলে চাকরি করেন। জাহেদার একটি ছয় বছরের পুত্র সন্তান আছে। আপাত দৃষ্টিতে জাহেদার সুখী সংসার। জাহেদার স্বামী মেহেবুব বহরমপুর ভাকুড়ির তালতলাতে একটি জমি কেনার বায়না ধরেছে বছর খানেক আগে। কিন্তু এখরচ সে খরচের জন্য জমিটা রেজিস্ট্রি আর করতে পারে না মেহেবুব। ছুটিতে বাড়ি এসেছে মেহেবুব এবং ভেবেছে এবার রেজিস্ট্রি করবেই। খাবার টেবিলে ম্যাটগুলো যথাস্থানে রেখে তার উপর থালা রাখছে জাহেদা।
মেহেবুব - কি গো খেতে আসবো? বাবু ঘুমিয়ে যাবে, খেতে দিয়ে দাও।
জাহেদা - খাবার বাড়ছি তো চলে এসো।
মেহেবুব চেয়ারে এসে বসে বাড়া ভাতের থালায় হাত দিয়ে আনমনা হয়ে যায়। শিশুটিকে জাহেদা খাওয়াতে থাকে। জাহেদা মেহেবুবের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কি ভাবছে মানুষটা।
আপনমনে বলে মেহেবুব - জাহেদা তোমার টাকা পয়সার খবর তো আমাকে দাও না আমি জানতেও চাইনা। তবে এবার একটা বিপদে পড়েছি। যদিও তুমি কত টাকায় বা পাও হাসপাতালের গ্রুপ ডি এর চাকরি, কতই বা বেতন। তবু যদি কিছু সঞ্চয় থাকে তাই বলছিলাম, আগামী মাসেই জমিটা রেজিস্ট্রি করবো। জাহেদা বাচ্চার মুখে গ্রাস তুলে দিতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী সব এলোমেলো হয়ে যায়।
জাহেদার গ্রামীণ হাসপাতালে বহু মানুষের আনাগোনা হয়। তার কাজ আউটডোরে টিকিট দেওয়া। সেখানে তো প্রচুর ভিড় ঠেলাঠেলি কে আগে নেবে। টিকিট বিতরণের পর জাহেদারা আড্ডা জমায় আরও গ্রুপ ডি কর্মী, সিভিক ভলেন্টিয়ার নার্স দিদিরা এবং মাঝে মাঝে লোকাল সাংবাদিকও একজন আসে সেই আড্ডাতে। সে আড্ডাতে চা ডিম টোস্টের অর্ডার হয়। হাসপাতালের গেটে মাসির দোকানে। জাহেদার নামে খাতা। সেই খাতায় বিল ওঠে। জাহেদা সকলের মধ্যমনি কেননা দেখতে ফর্সা গোলগাল চেহেরা, হাসলে গালে টোল পড়ে। স্বাস্থ্যবতী চোখে লাইনার, ঠোঁটে লিপস্টিক ডগমগ চেহেরা। মুখে হাসি লেগেই থাকে।
হাসপাতালের সকলের প্রিয় দিদি। জাহেদা জয়েন করার পর সাংবাদিক বাবুর হাসপাতালে খবর সংগ্রহ করতে আসার ব্যাপারটা বেড়ে যায়। জাহেদার নামে অলরেডি হাসপাতালে রটে গেছে যেমন চেহারা তেমনি বড়ো মনের মানুষ। এই আনন্দে জাহেদা তো আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। আরও উদার হতে থাকে জাহেদা আজ এর জন্মদিনে খাওয়ানো কাল ওর বিবাহ বার্ষিকী, পরশু তার ছেলের অন্নপ্রাশন ইত্যাদি পারপাস। এদিকে সাংবাদিক বাবুর জন্মদিনে শুধুমাত্র জাহেদা ইনভাইটেশন পেল হেরিটেজ রেস্তোরাঁয়। জাহেদা নিজেকে স্পেশাল মনে করে ফুলের বোকে দামী ঘড়ি ইত্যাদি নিয়ে উপস্থিত। সাজ সজ্জায় বিশ্বজয়ের চমক! পোশাকও কিঞ্চিৎ মাদকতাময়!
সাংবাদিক বাবু - এসবের কি দরকার ছিল জাহেদা, আমি তোমাকে কিছু বলার জন্য একাকী খুঁজছিলাম। যাক আজ সেই দিন। তুমি এত অবুঝ, তুমি সরল মেয়ে আর এত ভালো যে আজ কালকার যুগে খুঁজে পাওয়া দায়। আর ঠোঁটের কোনে সলজ্জ হাসি এত মায়াবী চেহারা খুব কম দেখেছি। তুমি ওভাবে সকলের জন্য পয়সা খরচ করো কেন বলো তো? আমার ব্যাপারটা একদম ভালো লাগে না। আর এমন করবে না। বল করবে না হঠাৎ অতিরিক্ত আবেগ তাড়িত হয়ে কাছে এসে জাহেদার হাত দুটি ধরে ফেলে। জাহেদা এতটা ভেবে আসেনি। সে কিছুটা ঝাঁকুনি খেল তার চিন্তায়।
জাহেদা - অতটা ভেবে দেখিনি। আর এ ভাবে আমাকে কেউ কোনোদিন বোঝায় নি। ঠিক আছে তুমি বলছ যখন আর করবো না।
সাংবাদিক বাবুর টোপ যে এত সহজেই গিলে নেবে সে হয়তো বুঝে উঠতে পারে নি। জাহেদা সারা রাস্তা ভাবতে থাকে এই তো কয় দিনের পরিচয়। মানুষটা আমাকে কত কাছ থেকে দেখেছে আমার কথা ভেবেছে। জাহেদা আরও চোখ ধাঁধানো সাজগোছ করে ডিউটিতে আসে কিন্তু সাংবাদিক বাবু আর কয়দিন আসছেন না। ফোনও সুইচড অফ। সিভিক ভলেন্টিয়ারকে তার বাড়ি পাঠায় জাহেদা। জানা যায় সে বাড়িতেই আছে কিন্তু মন খুব খারাপ।
সিভিক - দাদা আমাকে জাহেদা দি তোমার খবর নিতে পাঠালো। কি ব্যাপার বলো তো? ফোন ধরছো না।
সাংবাদিক বাবু ভাবলো ওষুধে কাজ হয়েছে। বললে, তুই যা ভাই গিয়ে বল কাল আসবে দাদা হাসপাতালে। অসুস্থ ছিলাম বলবি।
সিভিক - আচ্ছা।
জাহেদার উদবেগ তো কমতে চায় না। মনে কত প্রশ্ন।
অবশেষে সাংবাদিক বাবু এলেন অপরাধীর মত মুখ করে - কিছু মনে করো না জাহেদা বাড়িতে খুব অশান্তি। তাই ফোন টোন সব অফ করে রেখেছিলাম। এটা কোনো জীবন জাহেদা বল? এই গ্রাম্য সাংবাদিকতায় আর কত টাকা রোজগার হয় তোমার তো ধারণা আছে। বাড়িতে দিন রাত অশান্তি, অভাব অনটন মনে হয় সুইসাইড করে ফেলি।
জাহেদা - এই কাজই তোমাকে করতে হবে কেন? ভাব, অন্য কোনো কাজ করো।
সাংবাদিক - কিন্তু টাকা কোথায় পাব বলতে পার? আমার মত একটা অপদার্থ বেকার ছেলে। স্বপ্ন দেখেছিলাম একটি ঔষধের দোকান করব, ফার্মেসি। কিন্তু টাকার অভাবে পারছি না করতে ।
জাহেদা - তোমাকে টাকার চিন্তা করতে হবে না। আমি তোমাকে টাকা দেব, তুমি ব্যবস্থা করো।
সাংবাদিক - না জাহেদা ও কথা তুমি মুখেও আনবে না। তোমার টাকা আমি নিতে পারব না।
জাহেদা -কেন পারবে না বল, আমাকে তোমার বন্ধু ভাবতে পার না।
সাংবাদিক - পারি খুব পারি। তবুও...
জাহেদা - আমার মা মারা যাবার সময় সোনার অনেক গয়না আর চাঁদির কয়েন দিয়ে গেছে ওগুলো বিক্রি করে তোমাকে আমি দেব। ওগুলো আমার, কারও অধিকার নেই ওগুলোতে।
সাংবাদিক বাবুর চোখ অসাবধানতায় লোভে চকচক করতে শুরু করেছে। মুহূর্তে সামলে নিয়ে না না জাহেদা ওগুলো তোমার মায়ের স্মৃতি।
জাহেদা - না বলো না। ওগুলো দিয়ে তোমার স্বপ্ন পূরণ হবে। তুমি দোকান করো। তোমার অভাব ঘোঁচাও। অতি দ্রুততার সঙ্গে সাংবাদিক বাবুর সম্মতি সূচক মাথা নাড়া জাহেদা আবেগ মথিত থাকায় টের পায় না।
মেহেবুব - কি হলো? জাহেদা কি ভাবছো? যা হোক সঞ্চয় মনে হয় নাই, তাই না? কিন্তু তোমার সোনাদানা গুলোও তো দিতে পারো? গোল্ড লোন করে, আর আমি কোওপারেটিভ ব্যাঙ্ক থেকে চার লক্ষ টাকা লোন করেছি তুমি তো জান। তোমাকে রাখতে দিলাম। জাহেদা অন্যমনস্ক ভাবেই মাথা নাড়ে। মেহেবুব তার দুই বন্ধুকে নিয়ে বাড়ি আসে। তাদের গ্রীল বারান্দায় বসতে বলে। রেজেস্ট্রি করতে হবে টাকা গুলো ট্রান্সফার করতে হবে। ড্রয়ার খুলে চাবি নিয়ে লকার খুলে দেখে লকার ফাঁকা কিছুই অবিশিষ্ট নেই।
হাসপাতালের গেটের বাইরে একশো মিটারের মধ্যে সাংবাদিক বাবুর ফার্মেসি উদ্বোধনের ব্যবস্থাপনা রেডি। ফার্মেসির নাম 'শিউলি' ফার্মেসি। উদ্বোধনের দিন জাহেদা গিয়ে দাঁড়ায় সেই অনুষ্ঠানে। সাংবাদিক বাবুর পাশে ২৮-২৯ বছরের একটি মেয়ে পাতলা ছিপছিপে শ্যামলা, মিষ্টি মুখের গড়ন হেসে হেসে তারা কথা বলছে। তিনি পরিচয় করিয়ে দিলেন এ হল শিউলি আমার বাগদত্তা আগামী শ্রাবণেই আমাদের বিয়ে। শিউলি ইনি হলেন জাহেদা খাতুন, হাসপাতালের গ্রুপ ডি কর্মচারী।
জাহেদা গ্রীষ্মের দুপুরে জানালা খুলে এ কথায় ভাবে – দায়ী আসলে কে? সাংবাদিক না সে নিজে? সাংবাদিক না হয় টাকার জন্য টোপ দিয়েছে, সে কী জন্য তা গিললো? মেহেবুব কি প্রতারিত হয়নি? সে বুঝতে পারেনা, কেবলই জমাট বাঁধা অস্বস্তি নিয়ে ঝাপসা চোখে তাকিয়ে থাকে!
- দ্বি-মাসিক পত্রিকা -
সম্পাদক: মোঃ আযাদ হোসেন
গ্রাহক পরিষেবা: রনিক পারভেজ, ৯৩৭৮৪৮০১৯১
পাণ্ডুলিপি (ম্যানুস্ক্রিপ্ট) প্রস্তুতি ও সম্পাদনা : মোঃ মিনারুল হক
নামলিপি ও প্রচ্ছদ চিত্র: হিমাদ্রী শেখর মজুমদার
সত্বাধিকার: ভয়েস মার্ক কালচারাল গ্রূপ
RNI Ref. Number: 1343240
সম্পাদকীয় দপ্তর:
ভগবানপুর , আষাঢ়িয়াদহ
লালগোলা, মুর্শিদাবাদ
পিন - ৭৪২১৪৮
azadm.1981@gmail.com, voicemark19@gmail.com