গল্প

জাঁতিকল

সুকৃতি

আমি ছোট থেকেই খুব অন্তর্মুখীন ছিলাম।  মেয়েদের সাথে মেলামেশা তো দূর চোখ তুলে চাইতেই পারতামনা।   বন্ধু বলতে একজনই, রবিন।   তখন ক্লাস নাইনে পড়ি।  একটা কালো রঙের ধিঙ্গি মেয়ে চুমকি।  সবাই  অবশ্য মদ্দানি বলত...প্রতিদিন স্কুল থেকে আসার সময় আমাদের সাথ নিতে লাগলো।  অনেক বাচাল।  রবীন আর ওর কথা শেষ  হয়না, মনে হয় ওরা দুটো বান্ধবী।  প্রথম প্রথম খারাপ লাগত।  ওদের কথায় যোগ দিতাম না।  একদিন রবীনের মাধ্যমে আমাকে ও চিঠি দিল।  চিঠি আমি দিতে পারতাম না, তবে অপেক্ষা করতাম চিঠি পাবার।  আমার জীবন রঙিন হয়ে উঠলো।    

এভাবেই মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক  পরীক্ষা হয়ে  গেল।  আমি বাড়ি থেকে প্রায় চার কিমি দূরে একটা হোমিও ফার্মাসিতে কাজ পেলাম-অংক ও ইংরেজিতে ভালো রেজাল্ট ছিল বলে।   তাছাড়া আর্থিক এই দুরবস্থার মাঝে পড়াশোনা চালানো অসম্ভব ছিল।  কদিনের মধ্যেই  আব্বার কাছে ওদের বাড়ি থেকে আমার বিয়ের প্রস্তাব এল।  আব্বা আমাকে সেকথা বলতেই আমি বলে দিলাম আমি ওখানেই বিয়ে করব। 

আব্বা অসন্তুষ্টের সুরে বললেন-ওই মেয়ের অনেক বয়স।

---আমি জানি আমার সহপাঠী।

 ---কয়েকটি ক্লাসে দু তিনবার থাকার পরের অবস্থা এটা, সেটা তুমি জানো?

আমি নিরুত্তর। আব্বা উৎসাহিত হয়ে বলতে থাকলেন---গ্রামে সবাই বলাবলি করছে এবং আমিও বুঝি, টাকাপয়সা ওয়ালা লোক বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে গেল! আমাকে মানুষ বলেই মনে করেনা।  ধাড়ি মেয়ের বিয়ে হচ্ছেনা, তাই এখন আদিখ্যেতা! ফার্মাসিতে কাজটা পেয়েছে, আর টনক নড়েছে অমনি! শোন ওখানে তোর বিয়ে কিছুতেই হচ্ছেনা।  

আমি আমতা আমতা করে বললাম--মেয়েদের একটু সাহস থাকলেই লোকে....,

মুখের কথা শেষ না হতেই আব্বা জোরের সাথে বললেন,....ওটা সাহস না দুঃসাহস! যে ছেলের মুখে কথা ফোটেনা আজকাল সেই...এরকম বিড়বিড় করতে করতে চলে গেলেন। 

দশ বছর বয়সে মা কে হারিয়েছি, আব্বা মায়ের মত করে সব যত্ন নিয়েছে--- রান্না করা, জামাকাপড় পরিচ্ছন্ন  রাখা, স্কুল পাঠানো।  সন্ধ্যায় পড়তে বসতে বলা সমস্ত।  আমার কাজ শুধুছোট বোনটাকে পাশে পড়তে বসতে নেয়া।  আমাদের ভিটে বাদে মাত্র পাঁচ কাঠা জমি আছে।  আব্বা বিড়ি বাঁধত আর জমিটুকুতে শাক সবজি করত।  ওদিকে চুমকিদের প্রচুর জমি জায়গা, আত্মীয় স্বজন, প্রভাব প্রতিপত্তি।  ওর বাপ রেজিস্ট্রি অফিসে ডিডরাইটারের কাজ করে, পার্শ্ব ইনকাম রয়েছে, সব মিলিয়ে ভালোই ।  প্রায়ই বিচার শালিশে তার ডাকও পড়ে।

যাইহোক অনিচ্ছা সত্ত্বেও আব্বা বিয়েতে মত দিলেন।  বিয়েটা হয়ে গেল।  ।দিন মোটামুটি ভালোই কাটতে লাগলো।  আমি সকাল নটায় বেরোচ্ছি।  আবার কাজ করে রাত নটায় ফিরছি।  মাঝেমধ্যে দুপুরে ফিরতাম, হোম টিউশনি করছি বলে আর হয়ে উঠছেনা।  দুপুরে প্রচণ্ড খিদে পায়। দুটাকা বাচানোর চিন্তা করছি ।  যাতে চুমকির নোটস, পরীক্ষার খরচপত্র যোগাতে পারি।  মাঝেমধ্যে এটা সেটা যেমন চুড়ি, লিপ্সটিক আনলে ওর মনটা ভালো হয়।   স্বচ্ছল জীবন যাপনে যেন কোন বাধা না থাকে।  তাছাড়া ও ভালো থাকলে সংসারটাতে ওর মন বসবে, আব্বাকে যত্ন করবে, বোনটা ভালোবাসা পাবে।  ।দিন রাত এই চিন্তা মাথায় ঘোরে।  রাত্রে বাড়ি ফিরে যখন শুনি আব্বা খেয়ে শুয়ে পড়েছে, খুব আনন্দ হয়।  ভাবতে থাকি , চুমকি বাড়িটা দেখুক, বাইরেটা আমি দেখি।  আব্বার কোন কষ্ট হতে দেবনা।   

একমাস মত হবে।  সেদিন বাড়ি ফিরতেই আব্বা এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল ---বউকে সাবধান করে দে, রবিনের সাথে দহরম মহরম ভালো লাগছেনা।

চুমকিও প্রায়ই যে ঘটনার উল্লেখ করতে থাকলো তাতে মনে হল আব্বার ওকে আগে থেকেই পছন্দ  নয় তাই হয়ত, তাছাড়া আব্বা  আগেকার মানুষ!

সেদিন মাঘ মাসের কনকনে শীত। তবু আমি ঘামেপুরো ভিজে।   ডান হাতে মোবাইলটা ভিজে গেছে।  কাঁপা কাপা বাম হাতে সাইকেলটা ছুটির গাছে ঠেস দিচ্ছি, পৃথিবীর সমস্ত জীবের চোখ আমাকে নিরীক্ষণ করছে।  পুরো উঠোন ভর্তি মানুষ।  রোজ রাস্তা ফাঁকা থাকে,রাত সাড়ে নটা মানে বুঝতেই পারছ, গ্রাম শুনশান হয়ে যায়।  কোনরকমে পাশ কাটিয়ে আমি ঘরের মধ্যে ঢুকলাম।  আমার স্ত্রী লাল রঙের শাড়ি পরে, মাথায় ওড়না দিয়ে মুখ নীচু করে বসে আছে।  কাঠের চেয়ারটায় আমি বসে পড়লাম।  আমি আস্তে আস্তে বললাম,....সবাই যা বলছে তা কি সত্যি? সে আগের মতই স্থির।  আমি ধৈর্য হারা হয়ে চিৎকার করে বললাম--বল?

এতক্ষণ বাইরে থেকে ভালই আওয়াজ আসছিল, সব কেমন চুপ হয়ে গেল, আমি দৃঢ  শান্ত গলায় বললাম--বল। চুমকি ফুপরে কেঁদে উঠলো ।আমি বসে থাকতে পারছিনা পায়চারি করছি, পাগুলো ঠিক চলছেনা আমার।  চাটাইয়ের ঘরে ছয় ফুট মত উঁচুতে একটু ফাঁক আছে, তার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে আতা গাছ আর মেহগনি গাছের পাতাগুলো শীতের জন্য সম্ভবত বেশি কালো আর ঠেসাঠেসি করে নিবিড় হয়ে চুপ করে।আছে।  বাইরে কথাবার্তা আবারো শুরু হয়েছে, ঘরের পাশে অজস্র কান অধীর হয়ে  আছে, ফিস ফাস শব্দ আসছে। ।নিমেষে চুমকি আমার পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়ল।  তার কোমরের নীচ পর্যন্ত  ঘন কালো চুল মাটিতে লুটোচ্ছে।  আমি নিচু হয়ে তার মুখ তুলে বললাম, বল।  তার চোখ মুখ চোখের জলে সিক্ত।  আমাকে ডাকা হল বাইরে থেকে একপ্রকার হাঁক দিয়ে।

সালিশ বটে! আমি থ  বনে গেলাম, এত ঠান্ডায় প্রায় পাঁচশোর কাছাকাছি লোক, ছেলেপুলে মিলে। ১৪/১৬ সাইজের ত্রিপল টাঙানো যেখানটায় মুরুব্বি মোড়লরা আছে, আমাকেও সেখানেই একটা টুলে বসতে দেয়া হল। আমার মা  মারা যাবার সময়ও এত লোক হয়নি আমার স্পষ্ট মনে আছে।  ঘটনার নির্লজ্জতা ও ভয়াবহতা কি মাপের তা জানার অপেক্ষা করছি। 

দেখা যাক চুমকি কি বলে! আব্বাকে বলতে দেয়া হল, আগের পিছের মিলিয়ে অনেক কিছুই তিনি বললেন।  বেশিরভাগই চেনা কথা।  চুমকি বরাবরই আব্বার অপছন্দের।  মাঝে মাঝেই শ্বশুরের দিক হেকে হুঙ্কার এল ….।আমার মেয়ে অমন না তেমন না, তেমন হলে রবিন হিরের টুকরো, ওর সাথেই বিয়ে দিতাম ইত্যাদি ইত্যাদি।   আব্বা নিজের কথার মাঝে প্রতিপক্ষকে প্রত্যুত্তর দিলেন ---আরে ছাড়েন ছাড়েন, বাড়ি বয়ে এসে বিটির বিয়ে দিয়েছেন, উঁচু বংশের মুখে কালি!  

এইভাবে দুই পক্ষের কথার মাঝে মাঝে মোড়লের ভাই শুধু বললে, কার বাচ্চা কাঁদে? শালিশ শুনার খুব শখ, বাড়ি যাও, ছেল্যাকে ঘুম পাড়াও।  

রবিনের উক্তি---সে খারাপ বা  অন্যায় কিছু করেনি।  চুমকিকে ডাকা হল, সে এলে, মোড়ল বললেন--তোমার শ্বশুরের অভিযোগ, তুমি  আজ সন্ধ্যায় স্বামী ও শ্বশুরের অনুপস্থিতিতে রবিনের সাথে ঘরে ছিলে, অপ্রস্তুত অবস্থায় থাকাকালীন তোমার  শ্বশুর বাড়ি এসে দরজায় শেকল দেয়।  কয়েকজন পাড়ার লোকের উপস্থিতিতে দরজা খুলে তোমাদের বের করা হয়, তারাও এখানেই আছে।  তোমার কিছু বলার থাকলে বল।  

চুমকি বলল--আমি কলেজের পরীক্ষা নোট পড়ে দিই।   সেগুলোই রবিন দিয়ে যায়।  আজকেও...।  আব্বা মেজাজ হারিয়ে চিৎকার করে ওঠে বললেন----হারামজাদি....।  আমি বললাম---এর আগে আব্বার অভিযোগ শুনে রবীন যেন না আসে তা তুমি ও রবীন দুজনকেই বলেছি।  তুমি যে ঠিক বলছ আমি কিভাবে বিশ্বাস করব? মোড়লের কথায় চুমকি কোরান ছুঁয়ে বললে-- শ্বশুর আমাকে অপবাদ দিচ্ছে।  আমি নির্দোষ। 

আমি হতবুদ্ধির ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলাম।   

মোড়ল বললেন---ফজলু মিঞা কি বলেন? আব্বার প্রত্যুত্তর--আমার ছেলে যদি ওই মেয়ের সাথে থাকে তবে আমি তাকে ত্যাজ্যপুত্র করব।  

সেই রাতেই ছোট বোন আর আব্বাকে ফেলে চুমকির সাথে কেমন করে যে বের হয়ে এলাম আমিই জানি।  

আমাদের ও চুমকির বাবার বাড়ি থেকে প্রায় দুকিমি দূরে রাস্তার  ধারে শ্বশুরের ভিটেয় আমাদের নতুন সংসার পাতা হল।  ও কোথায় কি রাখবে, ঘর কেমন করে সাজাবে তাই নিয়ে বিভোর হয়ে গেল, আমার পৃথিবীটা একার মনে হল---আমি ত্যাজ্য।  আজ আকাশের তারারা মাখামাখি করে আছে, গাছেরা নিস্তব্ধ  নিঝুম হয়ে পরম শান্তিতে , শুধু আমি একা। 

মাস দুয়েক যেতে না যেতেই চুমকির কথায় ব্যবহারে প্রকাশ পেল, আমি শ্বশুরের ভিটেয় থাকি।  বছর হতেই আমার পুত্রসন্তান হল, বাড়িতে কাটানোর সময় আরও সীমিত হতে লাগলো, ছেলের জন্য এটা ওটা, মায়ের ভালোথাকা, নতুন জমি কেনাও দরকার।  একদিন হঠাৎ রবীনের সাথে চুমকিকে বাড়ির উঠোনে রাস্তার ধারে কথা বলতে দেখলাম, তখন আমি সাইকেলে করে মাত্রই ফিরছি।  আমাকে দেখা মাত্রই তাদের হাসির খিল খিল শব্দ বন্ধ হয়ে গেল।  পিছে পিছে চুমকি এল।  সোজা ঘরে ঢুকে বললাম---তোমার কথায় বিশ্বাস রেখে বাড়ি ছেড়েছি।  তার এই দাম! চুমকির উত্তর ---শত্রু কথা বললেও তার উত্তর দিতে হয়।  আদিম যুগের লোক কোথাকার!  

এত ধীর আর তীক্ষ্ণ গলার স্বর আগে কখনো শুনিনি।  ---তাহলে তোমার সাথে আমার থাকা হচ্ছেনা।  সে কঠিন গলায় উত্তর দিলে---তোমার সাথে আমি থাকছিনা, তুমিই আমার সাথে থাকছ! কেবলই  মনে হল আমি আব্বার দ্বারা পরিত্যক্ত হয়েছি, আর কারোর গলাধাক্কা খেতে চাইনা। ।তার সাথে আমার দূরত্ব বাড়তে লাগলো। আমি রাতে কখনো খাই বা খাইনা সে বিশেষ খোঁজ নেয়না।  কোন সমস্যা হলনা, কেউ তেমন জানলোও না, কয়েক দিনের মধ্যে মিউচুয়াল ডিভোর্স হয়ে গেল। 

বিড়ির মহাজন আজম খাঁর তখন ভালো রমরমা, লোকটা আমাকে স্নেহ করত।  রাতে ফিরে তার বিড়ি সেঁকা, প্যাকেট করা, এইসব বিনা পারিশ্রমিকে করতে থাকলাম।  ওখানেই ঘুমিয়ে যেতাম একটা বেঞ্চিতে।  দু তিন দিনের মধ্যেই পাড়ায় রাষ্ট্র হয়ে গেল ডিভোর্সের কথা।  দশদিন যেতেই একদিন মোড়ল ডেকে বললেন ----তোমার দেখা পাচ্ছিনা, দুদিন থেকে ঘুরছি।  আমি অবাক হয়ে বললাম ---তাই!বলেন কি বলবেন?

---দেখ বাচ্চা টাচ্চা হয়ে গেছে, এসব মিটমাট করে নিলেই ভালো হয় না বাছা!

এরপর প্রায়ই আমার কাছে পাঠান বংশ থেকে লোক আসতে লাগলো।  আমার বাচ্চা এত বড় হয়েছে, কবে কেমন অসুস্থ হচ্ছে, কবে বসতে শিখলো, ওর মা এখন বুঝতে পেরেছে ওর ভুল ইত্যাদি ইত্যাদি। এভাবে বছরখানেক কেটে গেল বোধহয়।  একদিন সন্ধ্যার সময় চুমকি ও তার বাপ ফার্মাসিতে গিয়ে হাজির।  মেয়ের কান্না, বাপের অনুনয় বিনয়, সর্বোপরি আমার ছেলের দিকে চেয়ে আমি থাকতে পারলামনা।  আবার বিয়ে পড়ানো হল আমাদের। 

এরপর বেশ কয়েকবছর কেটে গেছে।  ফার্মাসির কাজ বন্ধ হয়ে গেছে।  আমি বিড়ি বাঁধি, ওর মাও মাঝে মাঝে বাঁধে।  ছেলে বড় হয়ে গেছে।  বিদেশ খাটে।  বাড়িতে থাকার সময় ওর নানার জমিতে কাজ করে।  ওর মা একবেলা রান্না করে।  জালসায় যায়, ঈদ বকরা ঈদে নামাজের জামাত করে, রোজায় তারাবি পড়ায়।  সে সমাজের কাছে অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ধার্মিক হিসেবে পরিগণিত হতে লাগলো।   

সেদিক থেকে আমি কিছুই তেমন করিনা।  রমজান মাসে রোজাটা রাখি, শুক্রবারের নামাজ পড়া বন্ধ করে দিয়েছি। হোমিও প্র্যাকটিস শুরু করেছি।  লোকে জ্বর জ্বালা, ব্যাথা, সর্দিকাশি ইত্যাদির ওষুধ নিয়ে যায়।  ওষুধের ফিজ প্রায় বাকিই থাকে।  রোজগার আমার খুব কম।  বাড়িতে আমাকে কেউ মানুষ বলে মনে করেনা।  মা ছেলে কোথায় কখন যায় জিজ্ঞেস করার অধিকার আমার নেই।

একটি ঘটনায় আমাকে এই বাড়ি ছাড়তে হল।  একদিন খেতে পারছিনা,-খাবার ভালো লাগছেনা, বলাতেই চুমকি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো।  চোখের পলকে আমার ভাতের থালা কেড়ে আমার ছেলে আমার ডান পায়ে লাথি মারলো।  এই পৃথিবীতে আমি যে সত্যিই পরিত্যক্ত তা আবার উপলব্ধি করলাম।   

এই সংসার থেকে আমার  মন উঠে গেল একেবারে।  এবার সহজে আমাকে চুমকি ছাড়বেনা বোঝা গেল।  গ্রামের মুরুব্বি মাতব্বর, চুমকির বাপ চাচা সকলে আমাকে আইনি ফাঁসে আটকে দিল, যে পরিমাণ টাকা চাওয়া হল তার কানাকড়ি দেবার মত সামর্থ্য আমার ছিলনা।  কাজেই  মাসে মাসে খোরপোশের বাঁধনে আমি আটকা পড়লাম।   

আমার ঠাঁই আবার সেই মহাজনের বাড়ি।  আব্বার জন্য বাড়ি ছাড়ার পর থেকে বুকে হাহাকার ছিল।  মাঝে মাঝে ডুকরে ডুকরে কাঁদতাম।  কিন্তু এবার যেন সয়ে গেছে।   শুনেছি বোনটার বিয়ে হয়েছে।  আব্বার শরীর তেমন ভালো নেই।  আমি হঠাৎই কিছু না ভেবে এক সন্ধ্যায় সেই আমার বাপের ভিটেয় পা রাখলাম।  একবারের জন্য একটু কথা বলে বাইরে কোথাও চলে যাব।  এখানে আর মন টিকছেনা।  এমনই ভাবছিলাম।  আমাকে দেখেই তিনি প্রথমে চিনতে পারেননি, চিনবার কথাও নয়।  আমার মুখভর্তি দাঁড়ি, ।চোখ ঢুকে গেছে।  বেশিরভাগ চুল দাড়ি সাদা। তিনি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। ঘরের অবস্থা জরাজীর্ণ, বিছানা জামাকাপড় সব ময়লা, তেলচিটে।  তার দেহটাও কঙ্কালসার। 

বোনের বিয়ের ১০ বছর হয়ে গেছে,।   মাঠের জমিটা তাকে দেওয়া হয়েছে।  ইদানিং আব্বাকে ওর শ্বশুরবাড়ি থেকে ভিটেবাড়ি লিখে দেবার জন্য খুব চাপ দিচ্ছে।  জীবনটা যখন এভাবে হেলায় কাটালাম, তখন আব্বার শেষ বয়সের ভারটা নিলে ধন্য হব।  এইভেবে আব্বার কাছে, আমার সেই আবাল্য স্মৃতি জড়িত মাটির ঘরে থাকতে শুরু করলাম।   মনে হল আমি নতুন জীবন ফিরে পেলাম, সেইদিন শুধু আমিই যে ত্যাজ্যপুত্র হয়েছিলাম তাই শুধু নয় এই মানুষটাও সেদিন ত্যাজ্যবাবা হয়েছিল। তাই অনুভব করে বুকের মধ্যে চাপ চাপ বেদনা জমা হতে লাগলো। দেখলাম, ভালোবাসার অভাবে সেও মৃতের মতই......এরকম একটানা ঝড়ের মত গতিতে চলতে চলতে হঠাৎ…।আদিল সাহেব থেমে যাওয়াই আমি ও আমার বন্ধু সুধীর সম্বিৎ ফিরে পেলাম। 

সুধীর বললো ---তারপর?

পাঞ্জাবি থেকে রুমাল বের করে তিনি তখন তার চোখের কোণ পরিষ্কার করার ভাব করে নিজেকে সামলে নিচ্ছেন, আমি স্পষ্টই বুঝলাম ধরে যাওয়া গলার স্বর আড়াল করতে উঠে গিয়ে ওষুধের শিশি খুঁজতে  লাগলেন।  টেবিলের একধারে তিনি আবার আগের মত বসলেন, আমরা বিপরীত দিকে দুজন দুটো চেয়ারে বসে আছি।  

তিনি বললেন---তারপর আবার বিয়ে করলাম, বয়স তখন পঁয়তাল্লিশ হবে।  তাঁরও আগে একবার বিয়ে হয়েছিল।  আমার এখন বয়স পঞ্চান্ন।  সংসার চালানো, সামাজিক রীতি রক্ষা, আব্বা বিছানাগত তার দেখভাল সমস্তই সে প্রাণ ঢেলে করে, কোন বিষয়েই আমাকে চিন্তা করতে হয়না।  মাঝে দু বার জেল খেটেছি আগের পক্ষের খোরপোশ সময় মত না দেবার জন্যে।  আমার বন্ধু নিবিষ্ট চিত্তে ঘটনা গলাধঃকরণ করছে লক্ষ্য করলাম। 

আমার নিজের কাছে খুব লজ্জা পেতে লাগলো।  ভেবেছিলাম বন্ধু মহলে প্রশংসনীয় নারী উন্নয়ন আর অধিকার নিয়ে আমার লেখাটি বিশেষ ভাবে পড়তে বলব।কিন্তু এ কেমন সমাজ! যে সমাজ নারী অধিকারের অছিলায়, নিজেদের প্রভাব বজায় রাখতে একটা নিরীহ লোককে দাপুটে মেয়ের সাথে পুনরায় বিয়ের ফাঁদে ফেলে তার জীবনকে নিয়ে ছিনমিনি খেলছে।  পঞ্চান্ন বছরের মানুষটা দুর্ঘটনার ভারে একপ্রকার বুড়ো হয়ে গেছে।  ইতিমধ্যে আমাদের কেউ চা দিয়ে গেছে।  ডাক্তারবাবু স্যামুয়েল হানিম্যানের বইটি গভীরভাবে নিরীক্ষণ করছেন, মনেই হচ্ছেনা এত ঘটনা তাঁর জীবনেরই।  

চায়ে চুমুক দিতে দিতে ভাবছি, যাবার বেলায় এই মহিলাকে একটা প্রণাম করে যাব, এমন সময়  হুশ করে এসে পুলিশের গাড়ি থামলো।  সুধীর জব্বর ভয় পেয়ে গেছে, ডাক্তারবাবু নির্ভয়ে উঠে দাঁড়ালেন।  দেখলাম, আমার দ্বিতীয় বর্ষের প্রথম সংখ্যা হানিমানের পাশে বেশ জায়গা করে নিয়েছে।

:: ভয়েস মার্ক ::

- দ্বি-মাসিক পত্রিকা -

সম্পাদক: মোঃ আযাদ হোসেন

গ্রাহক পরিষেবা: রনিক পারভেজ, ৯৩৭৮৪৮০১৯১

পাণ্ডুলিপি (ম্যানুস্ক্রিপ্ট) প্রস্তুতি ও সম্পাদনা : মোঃ মিনারুল হক

নামলিপি ও প্রচ্ছদ চিত্র: হিমাদ্রী শেখর মজুমদার

সত্বাধিকার: ভয়েস মার্ক কালচারাল গ্রূপ

RNI Ref. Number: 1343240

-: যোগাযোগ :-

সম্পাদকীয় দপ্তর:
ভগবানপুর , আষাঢ়িয়াদহ
লালগোলা, মুর্শিদাবাদ
পিন - ৭৪২১৪৮

azadm.1981@gmail.com, voicemark19@gmail.com

:: সামাজিক মাধ্যম ::