ষষ্ঠ বর্ষ। প্রথম সংখ্যা জানুয়ারি - মার্চ ২০২৪

সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ

পশ্চিমবঙ্গে ভদ্রলোক-ছোটলোক ক্ষমতার বাইনারিঃ উঁকি দেয় চণ্ডক্ষমতা

সম্পাদক

‘আরেক রকম’ পত্রিকার এপ্রিল ২০২৪ সংখ্যায় পবিত্র সরকার লিখেছেন ‘ভদ্রলোক’ না ‘ক্রিমিনাল’: বাইনারির সংকট। তিনি লিখেছেন তিনি সমাজবিজ্ঞানী নন। তার লেখাটিকে তাই সাধারণ নাগরিকের লেখা হিসেবে ধরতে হবে। গৌরচন্দ্রিকা বাদে যে বক্তব্যটা তিনি উপস্থাপন করেছেন তার মর্ম নিম্নরূপঃ    

পশ্চিমবঙ্গে শ্রেণি দুটি। ভদ্রলোক ও ক্রিমিনাল।  তিনি মনে করেন অপরাধীদের সাথে ভদ্রলোকদের কোনও পার্থক্য আজ আর অবশিষ্ট নেই। প্রমাণ হিসেবে তথাকথিত ভদ্রলোক শ্রেণির মত আচার-ব্যবহারযুক্ত ব্যক্তিগণের ক্রিমিনাল রূপে জেলবন্দি থাকা এবং তাদের কাছে রাশি রাশি গচ্ছিত ধন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হওয়ার ব্যাপারটি উল্লেখ করেছেন। লেখক আরও বলেছেন, এইসব দেখে শুনে তার ‘ভদ্রলোক’ নৈতিকতার যে সীমানা থেকে তিনি ব্যাপারসমূহকে অবলোকন করে থাকেন, সেই বোধগুলি ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। জীবন সায়াহ্নে এসে এই তার আক্ষেপ। 

তিনি আরও বলেন যে উক্ত ‘ভদ্রলোকরা’ এবং তারা যে জীবনবোধের প্রবক্তা সেটা এসেছে “কমিউনিস্ট” ভাবধারা থেকে। 

সমাজবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা করতে বসে একাডেমিক তকমা ছাড়া সে আলোচনা করা যাবে না এই ধরণের বিনয় প্রকাশের বিষয়গুলি বাদ দেওয়া গেল। সেক্ষেত্রে সমাজবিজ্ঞানীর প্রাতিষ্ঠানিক তকমা না থাকায় এই অধমেরও লেখাটির পাঠ-প্রতিক্রিয়া জানানোর এক্তিয়ার থাকেনা।

লেখকের ভাষায় ‘ভদ্রলোক’ এবং তার উল্টোদিকে থাকা ক্রিমিনাল অর্থাৎ আমাদের  ভাষায় ‘ভদ্রলোক’ ও তার উল্টো দিকে থাকা ‘ছোটলোক’ ব্যাপারটি কী এবং কেমন করে তার একটি বস্তুবাচক ( মার্কসীয় ) ব্যাখ্যা হাজির করা যাক। তাহলেই লেখকের আত্ম-ব্যাঙ্গাত্মক লেখন-শৈলীর নেপথ্যের বিষয়টিও প্রাঞ্জলভাবে উন্মোচিত হবে।   

ক্ষমতার পালাবদলঃ ভদ্রলোকের ক্ষমতা 

খুব বেশি দূরে যাওয়ার দরকার নেই। ষাট-সত্তর দশকের নানাবিধ আর্থসামাজিক আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের পতন ঘটে এবং বামপন্থী বলে পরিচিত সিপিএম এর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসে।

লক্ষণীয় এই বামফ্রন্ট ক্ষমতা আসার আগে ব্রিটিশ ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রাম, শ্রমিক আন্দোল, কৃষক আন্দোল এবং স্বাধীনোত্তর কালে খাদ্য আন্দোলন, তেভাগা কৃষক আন্দোলন, দার্জিলিং এর নকশালবাড়ির কৃষক আন্দোলন ইত্যাদি পথ পরিক্রমায় মার্কসীয় জীবনবোধ সমাজ-পরিসরে সঞ্চারিত হয়েছিল। সেই সঞ্চারণ এই বামফ্রন্টি ক্ষমতা অধিকারের প্রেক্ষাপট হিসেবে কাজ করেছে। অবশ্য তার জন্য ১৯৭২ থেকে ১৯৭৭ পর্বে নকশালপন্থী বলে পরিচিত সিপিআই(এমএল) পার্টির সঙ্গে যুক্ত অসংখ্য তরুণ তরুণীকে জীবন আত্মাহুতি দিতে হয়েছে।  

মনে রাখা দরকার পশ্চিমবঙ্গের সমাজ পরিসর ব্রাহ্মণ্য বর্ণবাদী উত্তর ভারতের সমাজ পরিসরেরথেকে কিছুটা আলাদা হলেও বাংলায় বর্ণবাদ রাজনৈতিক পার্টির ছত্রছায়ায় বহাল তবিয়তেই ছিল।এই বর্ণবাদ তার পরগাছা জীবনটাকে টিকিয়ে রাখার জন্য রাজ্যে ক্ষমতার পালাবদলের সাথে সাথে তথাকথিত কম্যুনিস্ট ভাবধারার রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে যায়। এবং ব্রিটিশ ভারত থেকে প্রবাহিত এই বর্ণবাদী ‘ভদ্রলোকত্ব’ পরগাছামির ভিত্তি সহ শক্ত একটি স্থান পুনরায় অধিকার করে বসে। ভদ্রলোক পরগাছামির জীবন মধ্যবিত্ত্বীয় ব্রিটিশ উত্তরাধিকার সহ ঘুনসি মেরে বাঙালি জীবনের উপর উপর ভাসতে থাকলো। যার অন্যতম সিম্পটম হল আলোচ্য তথাকথিত ‘ভদ্রলোকত্ব’। অর্থাৎ এই ‘ভদ্রলোকত্ব’ হল ব্রাহ্মণ্যবাদী, পরগাছাবৃত্তির ধারক। সে ওতপ্রোত হয়ে গেল সিপিএমের ক্ষমতা-শীর্ষের সাথে। সিপিএমের নেতৃত্বে এই ‘ভদ্রলোকবৃত্তি’ তার বর্ণবাদী ও আর্থনীতিক শ্রেণিচরিত্রকে গোপন করে নিল।    

অর্থাৎ ক্ষমতা দখলের সঙ্গে সঙ্গে ব্রাহ্মণ্য বর্ণবাদী ‘ভদ্রলোকত্ব’ ক্ষমতাসীন সিপিএমের অঙ্গীভূত হয়ে যায় এবং ‘ভদ্রলোকত্ব’ তথা পরগাছামি সামাজিকভাবে শিলিভূত একটি স্ট্যাটাস ক্যু অর্জন করে। এই স্ট্যাটাস ক্যু মধ্যবিত্তীয় অর্থনৈতিক বর্গের আওতাভুক্ত থেকে ‘ভদ্রলোক’ তকমা সহ  ক্ষমতার অলিন্দে ৩৪ টি বছর পার করে দিল। আরোও একটু অভিনিবেশ সহ এইখানে আলোকপাত করলে বাঙালি সমাজ পরিসরের স্ট্যাটিক ও আলোড়নবিহীনতার নেপথ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে আলোচ্য ব্রাহ্মণ্য পরগাছামির ব্যাকগ্রাউন্ড!  

ভদ্রলোক ক্ষমতার প্রতিক্রিয়াঃ ছোটলোকদের জন্ম বৃত্তান্ত  

পশ্চিমবঙ্গের আর্থসামাজিক অবস্থা এই ক্ষমতার প্রতিক্রিয়ায় কী রুপ লাভ করে? 

হ্যাঁ, যে রূপ লাভ করে তা হল এক বিপুলসংখ্যক মানুষের ‘ছোটলোক’ হিসেবে ওই ভদ্রলোক শ্রেণীর তাবেদারি করবার ব্যবস্থাপনা। এই ‘ছোটলোকেরা’ তাবেদারি করতে বাধ্য হত ‘ভদ্রলোকদের’। ভদ্রলোকরা ছিল গ্রামের প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক, মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক, কলেজ শিক্ষক, সরকারি কর্মচারী হিসেবে রাজ্য-ক্ষমতার লালবাড়ির প্রাচীর থেকে শুরু করে একেবারে প্রত্যন্ত এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত। এই ‘ভদ্রলোকেরা’ তিন দশকের শাসনকালে  ‘ছোটলোক’দের লাঠিয়াল হিসেবে, লুম্পেন হিসেবে বিরোধী রাজনীতিকে কোণঠাসা করবার জন্য ব্যবহার করল। মুখে মার্কসবাদ এবং শ্রেণি রাজনীতির কথা বললেও কার্যক্ষেত্রে পুরোপুরি শ্রেণী সমঝোতা করে একই শ্রেণীর মানুষকে পরস্পরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে শাসনযন্ত্র নিজেদের অনুকূলে সচল রাখল। শ্রেণি সমঝোতা কেমন করে করলো? জমিদার-জোতদারদের পার্টির মধ্যে ঢুকিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে। জনগণের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব জাগিয়ে তাকে রাজনীতির ময়দানে টেনে এনে সেই দ্বন্দ্বের সমাধান করবার বদলে এই শ্রেণি-দ্বন্দ্বকে শ্রেণি-সমঝোতায় রূপ দেয়। জমির মালিক শ্রেণিকে অর্থাৎ ‘পুকুরভরা মাছ আর গোয়াল ভরা গরু’ নিয়ে গর্ব করা শ্রেণিটিকে ক্ষেত-মজুর আর ভাগচাষিদের থেকে বাঁচিয়ে দিল। এই শ্রেণিটিই তাদের ব্রাহ্মণ্য ব্যাকগ্রাউন্ড সহ পরবর্তীতে ক্ষমতাসীন সিপিএমের হর্তাকর্তা সেজে গেল! যারা পূর্বে সমাজের কর্তা ছিল এখন তারা রাজনীতির কর্তাও সেজে গেল! সোনায় সোহাগা! মহানগরীতে এরাই ভদ্রলোক!    

আবার পালাবদলঃ ভদ্রলোকদের অবস্থা  

গঙ্গা দিয়ে অনেক জল প্রবাহিত হল। ‘ছোটলোকরা’ এই ‘ভদ্রলোকদের’ ক্রমপ্রসারণশীল ‘ভদ্রলোকোচিত’ আধিপত্যের দাবি পূরণ করতে আর সক্ষম হচ্ছিলনা । ফলত, বাংলার আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হচ্ছিল এই ‘ভদ্রলোকদের’ থেকে মুক্তির ক্রন্দন । এই ধ্বনিটিকেই প্রতিধ্বনিতে রূপ দিয়ে ক্ষমতা কব্জা করলেন মমতা ব্যানার্জি তাঁর তৃণমূল কংগ্রেস পার্টির মাধ্যমে। মনে রাখা দরকার তিনি নিজেও ব্রাহ্মণ্য উচ্চবর্ণের মানুষ। কিন্তু তার জীবনশৈলী ‘ছোটলোকদের’ মতই। ফলে ‘ছোটলোকরা’ তাকে নেত্রী হিসেবে, কাছের মানুষ হিসেবে গ্রহণ করল খুব সহজেই। তিনি ক্ষমতায় এলেন ২০১১ সালে।

একটি রেজিমেন্টেড পলিটিক্যাল পার্টি যার বিভিন্ন শাখা সংগঠন গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত স্তরে স্তরে বিন্যস্ত। ভদ্রলোকদের সেই পার্টি সংগঠন আর আর্থসামাজিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের দাবিদারিত্ব পরিত্যক্ত হলো। তারা যে ‘ছোটলোকদের’ লুম্পেন বাহিনী রূপে খাড়া করেছিল সেই ‘ছোটলোকরা’ মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে নেতারূপে শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত ক্ষমতার ভাগীদার হয়ে গেল। ‘ছোটলোকরা’ ক্ষমতায় এসে যাওয়াতে ‘ভদ্রলোকরা’ অত্যন্ত রুষ্ট হলেন। কিন্তু রাজনীতির আঙিনায় এই রুষ্টতা অর্থহীন, পরিণামে ক্ষমতার কাছে দুয়োরানী হিসেবে তাকে আজও দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। সে যাতনা বড় কষ্টের। ইন্টারনেট মাধ্যমে সেই পার্টির যে অবশেষ এখনো রয়েছে, বিভিন্ন সময় ‘ভদ্রলোক’ হিসেবে তাদের সমাজ শাসনের অধিকার ঘোষণা করলেও রাজনীতির ময়দানে সেই সমাজের কাছে তারা আজও ব্রাত্য হিসেবে থেকে গেছে। এটি উক্ত ভদ্রলোকদের একটি অংশের হিসেব, যারা পূর্বতন ক্ষমতার ডিরেক্ট বেনিফিসিয়ারি ছিল! তাদেরই আরেকটি অংশ অতিদ্রূত উদীয়মান ক্ষমতা-কাঙ্খী ভারতীয় জনতা পার্টির সাথে ভিড়ে গেল! কিন্তু যেহেতু বাঙালি জীবন চেতনায় এই ভারতীয় জনতা পার্টি আর তার পূর্বসূরি জনসংঘ বা আরএসএসকে সুনজরে দেখা হয়না, তাই ক্ষমতা পরিত্যক্ত ভদ্রলোকরা সরাসরি সকলে মিলে বিজেপির সাথে যুক্ত হতেও পারলোনা। কিন্তু বর্তমান ছোটলোক ক্ষমতাকে মেনে নিতেও পারলোনা। এই অংশটা রয়ে গেল পূর্বতন পার্টির সঙ্গেই।

ভদ্রলোকদের এহেন মনোবিকলনের ফলে তারা আজকের দিনে রাজনীতিতে শত্রুমিত্র চিহ্নিত করবার ক্ষমতা পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছে। দেশ যে ক্রমশ ইলেকটোরাল অটোক্র্যাসিতে পরিণত হয়েছে সেটি তারা দেখতেও পেলনা। পড়ে রইলো তাদের বাংলা শাসনের ভদ্রলোকি প্রাধিকার বোধ নিয়ে! এই জন্যই সেই নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্রের ধারক বাহকরা যতটা না তাদের দ্বারা সমালোচিত তার চেয়ে বেশি সমালোচিত হচ্ছে এরাজ্যের তাদের ভাষায় ছোটলোক ক্ষমতা! তাই রাজনীতির বৃহত্তর প্রেক্ষায় পর্যন্ত নিজেদের সঠিক ভূমিকা না নিতে পারার দায়ে আগামীতে তাদের জবাবদিহি করতে হবে। দেশ অটোক্র্যাসি থেকে নির্বাচনহীন একনায়কতন্ত্রে ধাবিত হলেও তারা পড়েছিল এরাজ্যের ছোটলোক ক্ষমতার পেছনে। ইতিহাসের কাঠগড়ায় এর জবাব তাদের দিতে হবে। 

যাই হোক, শ্রীযুক্ত পবিত্র সরকার মহাশয় সেই ‘ভদ্রলোকদের’ প্রতিনিধি হিসেবে যুগের যৌবন খেকো যযাতি রূপে তার বাকি জীবনের দিন গুনছেন আর ফেলে আসা ‘ভদ্রলোক’-ক্ষমতার মৌতাতী স্মৃতি নিয়ে কেবলই আক্ষেপ আর আক্ষেপ করে চলেছেন।  

মনে রাখা দরকার নীতি-নৈতিকতা, দুর্নীতি, অপরাধ প্রবণতা প্রতিটি বিষয় আর্থসমাজ রাজনীতির প্রেক্ষাগত এবং ক্ষমতার চরিত্রগত। একটি উদাহরণ নিলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। পশ্চিমবঙ্গে তিন দশকের ক্ষমতায় সিপিএম কি পার্টি হিসেবে দুর্নীতি করেনি? করেছে অবশ্যই। কিন্তু সংগঠনের তলা থেকে উপর পর্যন্ত দুর্নীতি থেকে প্রাপ্ত অর্থ পার্টির ফান্ডেই ট্রান্সফার হয়েছে। ব্যক্তির কাছে কি যায়নি? গিয়েছে, নিশ্চয়ই গিয়েছে। কিন্তু কতটা গিয়েছে কীভাবে গিয়েছে, নিয়ন্ত্রণ কিন্তু থেকেছে পার্টির হাতে। এই পার্টি সেই টাকা থেকেই তার সদস্যদের ভাতা দিয়েছে, সরকারি ক্ষমতার অপসুযোগে চাকুরি দিয়েছে, নিরাপত্তা দিয়েছে। এসব সে কোন নৈতিকতায় করেছে? সমকালীন আইনি-নৈতিকতাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে সে এটা করেছে। ক্ষমতা থেকে সরে গিয়েই ‘ছোটলোকদের’ ক্ষমতা দখলের প্রতিক্রিয়ায় এবং শাসক দল ও তার বর্তমান স্বরূপে পার্টির সংগঠিত রূপ না থাকায়, পার্টি সংগঠনে নীচ থেকে ওপর পর্যন্ত স্তরবিন্যাস না থাকায়, দুর্নীতিকে কেন্দ্রীভূত রূপে বাইরে দেখা যাচ্ছে। এই যে বাইরে দুর্নীতির দেখা যাওয়াটা এবং আগের ক্ষেত্রে দেখা না যাওয়াটা আদ্যন্ত একটি টেকনিক্যাল বিষয়। এটা কোনো আইডিওলজির ব্যাপার নয়! এটা ম্যানেজমেন্টের ব্যাপার! ‘ভদ্রলোক’ ক্ষমতা এটা মেইন্টেইন করেছিল, ‘ছোটোলোক’ ক্ষমতা সেটা করতে পারছে না।   

তাহলে ‘ভদ্রলোকদের’ নীতিবোধের প্রাচীরগুলি সব খুলে খুলে পড়ছে কথাটা সত্য! কারণ ‘ভদ্রলোকরা’ নৈতিক গণ্ডি নামক  যে মিথ্যাত্ব নির্মাণ করেছিল যার ভিত্তিমূলে ছিল পরগাছামি আর শ্রেণি সমঝোতা! ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ায় সেই মিথ্যাত্বের দেওয়ালগুলি খসে পড়ছে এবং তার ভেতরের অন্তঃসারশূন্য ফানুসটা ফেটে বেরুচ্ছে বর্তমান ক্ষমতার নগ্ন উল্লম্ফনে!

একটা ব্যাপারে বর্তমান ‘ছোটলোক’ ক্ষমতাকে দোষ দেওয়া যায়না। এই ক্ষমতা নিজে নির্লজ্জ হয়ে লাজ প্রকাশের বিলাস করে না, যেখানে পূর্বোক্ত ‘ভদ্রলোক’ ক্ষমতা নিজে  নির্লজ্জ হয়েও দিনের পর দিন লাজপ্রকাশের ভড়ং করে গেছে, আজও করছে এবং প্রকারান্তরে দাবি করছে তারাই সমাজ শাসনের অধিকারী! কিন্তু সেটা প্রহসন কারণ সমাজ মন তাতে গলছে না। 

আসলে ‘ভদ্রলোক’ আধিপত্যকামিতা ব্যাপক জনতাকে অধিকার বঞ্চিত করে রেখেছিল দীর্ঘকাল! ‘ভদ্রলোক’ ক্ষমতার আওতায় ছিটেফোটা-ডোল ‘ছোটলোকদের’ গরিব মেহেনতি মানুষ হিসেবে দাগিয়ে দিয়ে তাকে রিলিফ বলে দেখিয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করতে থেকেছে দীর্ঘকাল জুড়ে। আর ‘ভদ্রলোক’-ই পরিসরে পার্টির নিবিড় আওতায় আর পারিবারিক স্বজনপোষণী অপকাণ্ডে গোটা সাড়ে তিনটি দশক গিলে খেয়েছে! 

কিন্তু সেই ‘ভদ্রলোক’ এবং তার আত্মপ্রসাদী মেন্টালিটির বাস্তবতা যে একটা ভঙ্গুর  মেন্টালিটির বৈশিষ্ট্য ছাড়া আর কিছুই নয়, তা আজ যখন সেই ‘ভদ্রলোক’ বাস্তবতার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে ‘ছোটলোকরা’ ক্ষমতার অলিন্দে ক্ষমতাকে নিয়ে লুফোলুফি খেলছে, জনতাকে নিয়ে লুফোলুফি খেলছে, তার অধিকার ভূলুণ্ঠিত করছে তখন তা পরিষ্ফূট হচ্ছে। কিন্তু ‘ছোটলোক’ ক্ষমতার এই যে জনতাকে নিয়ে লুফোলুফি খেলা তা সত্তেও শ্রীযুক্ত সরকার কথিত ‘ভদ্রলোকরা’ যখন জনপরিসরে গিয়ে নিজেদের শাসনাধিকারের সাফাই দিচ্ছে জনতা কিন্তু তাতে কর্ণপাত করছে না। এর কারণ সেই ‘ভদ্রলোক’ কর্ণার কি ব্যাখ্যা করবে? না তাদের হয়ে পবিত্র বাবু যদি একটু ব্যাখ্যা করেন!   

মনে রাখা দরকার পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম হচ্ছে সেই পলিটিক্যাল পার্টি যারা মার্কসইজমকে দীর্ঘকাল জুড়ে ব্ল্যাকমেল করেছে নিজের ‘ভদ্রলোক’ বর্ণবাদী অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য।

অতঃপর বর্তমান ক্ষমতার ‘ছোটলোক’ রূপ এবং অতীত ক্ষমতার ‘ভদ্রলোকী’ রূপ আসলে একই মুদ্রার দুই পিঠ! বাইনারি হল এ্যাপারেন্ট। অন্তঃসার একই!  

কথার শেষে

আসল কথা হল বাইনারি নয়। এর সংকটও নয়। ‘ভদ্রলোক’-‘ছোটলোক’ ক্ষমতার আপাত বাইনারির বাইরে গিয়ে গণজনতার দাবি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কোন আইডিওলজি গণজনতাকে সার্ভিস দিতে পারে? সেই আইডিওলজির সন্ধান করা কি আজ অত্যন্ত জরুরি বিষয় নয়? যা নির্মূল করবে ব্রাহ্মণ্য বর্ণবাদী পরগাছামির ‘ভদ্রলোকত্ব’ এবং সেই প্রতিক্রিয়া থেকে জন্ম নেওয়া ‘ছোটলোক’ ক্ষমতার অভব্যতা! প্রতিষ্ঠা করবে শ্রম তথা মূল্য অর্জন-বিন্যাসী বাস্তবতা। 

মনে রাখা দরকার ছদ্ম-আইডিওলজি বা আইডিওলজির সাইনবোর্ড কিম্বা আইডিওলজি বিহীনতার বিষয়গুলির পরিণাম যে কী পশ্চিমবঙ্গের গত ৫০ বছরে ইতিহাস তার জীবন্ত সাক্ষ্য!

এবং আজ নাহোক কাল সেই আইডিওলজির সন্ধান না পেলে দেশব্যাপী যে চণ্ড-ক্ষমতাধিপত্য হুমকি স্বরূপ তার খপ্পরে বাঙালিকে পড়তেই হবে!  

 

:: ভয়েস মার্ক ::

- দ্বি-মাসিক পত্রিকা -

সম্পাদক: মোঃ আযাদ হোসেন

গ্রাহক পরিষেবা: রনিক পারভেজ, ৯৩৭৮৪৮০১৯১

পাণ্ডুলিপি (ম্যানুস্ক্রিপ্ট) প্রস্তুতি ও সম্পাদনা : মোঃ মিনারুল হক

নামলিপি ও প্রচ্ছদ চিত্র: হিমাদ্রী শেখর মজুমদার

সত্বাধিকার: ভয়েস মার্ক কালচারাল গ্রূপ

RNI Ref. Number: 1343240

-: যোগাযোগ :-

সম্পাদকীয় দপ্তর:
ভগবানপুর , আষাঢ়িয়াদহ
লালগোলা, মুর্শিদাবাদ
পিন - ৭৪২১৪৮

azadm.1981@gmail.com, voicemark19@gmail.com

:: সামাজিক মাধ্যম ::