প্রতি বছরের ন্যায় এবছরেও অনুষ্ঠিত হলো পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ পরিচালিত মাধ্যমিক ২০২৪ পরীক্ষা। এরাজ্যের দশম শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষাবর্ষ শেষে এই পরীক্ষা দিয়ে থাকে। প্রাথমিক, উচ্চ-প্রাথমিক ও নবম-দশম শ্রেণীর ধারাবাহিক ১০ বছর পঠন-পাঠনের পর ছাত্র-ছাত্রীদের এটাই প্রথম বড় পরীক্ষা। বর্তমানে সাতটি মূল বিষয়ের পরীক্ষা হয় মাধ্যমিকে। বিষয়গুলি হলো বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস, ভূগোল, গণিত, জীবনবিজ্ঞান ও ভৌতবিজ্ঞান। এছাড়াও ঐচ্ছিক বিষয়ের পরীক্ষা থাকলেও বিগত দিনের মতো ঐচ্ছিক বিষয়ের গুরুত্ব তেমন নেই অর্থাৎ সকল ছাত্র-ছাত্রী এই ঐচ্ছিক বিষয়ের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে না। এবছরের মাধ্যমিক পরীক্ষা ২রা ফেব্রুয়ারি থেকে ১২ই ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়। লোকসভা নির্বাচনের কারণে এই বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা গত বছরের তুলনায় ২১ দিন এগিয়ে আনা হয়েছে।
এবছরের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা গত বছরের তুলনায় প্রায় আড়াই লাখ বেশি। এবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দিলো ৯ লাখ ২৩ হাজার ১৩ জন (৯২৩০১৩ জন)। এর মধ্যে ছাত্রী পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ৫ লাখ ১৭ হাজার ১৯ জন (৫১৭০১৯ জন) এবং ছাত্র পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ৪ লাখ ৫ হাজার ৯৯৪ জন (৪০৫৯৯৪ জন)। পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি হলেও পরীক্ষা কেন্দ্রের সংখ্যা গত বছরের থেকে প্রায় ২০০ টি কমিয়ে দিয়েছে মধ্যশিক্ষা পর্ষদ। এবছর মাধ্যমিক পরীক্ষার মূল পরীক্ষাকেন্দ্রের সংখ্যা ২৬৭৫টি, গত বছর যেটা ছিল ২৮৬৭ টি।
পরীক্ষা সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন করার জন্য বরাবরের মতই কন্ট্রোল রুম খোলার সিদ্ধান্ত নেয় মধ্যশিক্ষা পর্ষদ। পরীক্ষা শুরুর বেশ কয়েকদিন আগেই ২৬ জানুয়ারি সকাল ১১ টা থেকে খুলে দিয়েছে হেল্পলাইন নম্বর। পরীক্ষার্থীর কোনো সমস্যার কথা বা মাধ্যমিক পরীক্ষার ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কোনো প্রশ্ন থাকলে হেল্পলাইন নম্বরে ফোন করে সেটা জিজ্ঞাসা করতে পারবে। মধ্যশিক্ষা পর্ষদ পরীক্ষা সংক্রান্ত সমস্ত রকম সহযোগিতার জন্য কন্ট্রোল রুম ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখার ব্যবস্থা করে। পরীক্ষার সময়ও কোনও পরীক্ষার্থী সমস্যায় পড়লে হেল্পলাইন নম্বরে ফোন করতে পারবে অভিভাবকরা বলেও জানায় মধ্যশিক্ষা পর্ষদ। সেই ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সহযোগিতার চেষ্টা করবে পর্ষদ।
মাধ্যমিক পরীক্ষার সময়ের ক্ষেত্রে বিগত বছরগুলোর সাপেক্ষে এবার আমূল পরিবর্তন এনেছে মধ্যশিক্ষা পর্ষদ। বিগত বছরগুলিতে মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু হত ১১ টা ৪৫ মিনিট থেকে এবং শেষ হত বিকেল ৩ টের সময়। কিন্তু এবছর পরীক্ষা শুরুর মাত্র ১৫ দিন আগে মধ্যশিক্ষা পর্ষদ পরীক্ষার সময় ২ ঘন্টা এগিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়। অর্থাৎ পরীক্ষা শুরু হবে সকাল ৯ টা ৪৫ মিনিটে এবং শেষ হবে দুপুর ১ টায়। অল্প সময়ের ব্যবধানে পরীক্ষার সময় পরিবর্তনে পরীক্ষার্থীসহ শিক্ষকরাও (ইনভিজিলেটর) সমস্যায় পড়বে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করে শিক্ষামহলের বৃহৎ অংশ। এমনকি এ বিষয়ে কলকাতা হাইকোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলাও রুজু করে শিক্ষা অনুরাগী মঞ্চ নামে একটি শিক্ষক সংগঠন। মধ্যশিক্ষা পর্ষদকে ভর্ৎসনা করলেও স্বল্প সময়ের মধ্যে আবারও পরীক্ষার সময় পরিবর্তন করলে প্রশাসনিক কাজে ব্যঘাত ঘটতে পারে বলে মধ্যশিক্ষা পর্ষদের পক্ষেই রায় প্রদান করে কলকাতা হাইকোর্ট।
এই সব কারণে পরিবহন ব্যবস্থার ওপর বিশেষ নজর দেয় মধ্যশিক্ষা পর্ষদ। জেলায় জেলায় সকাল সাড়ে ৫ টা থেকেই পরিবহন ব্যবস্থা চালু করে। বিশেষ করে সরকারি বাস চলাচলে জোর দেয়। কলকাতায় স্পেশাল বাস পরিষেবার ব্যবস্থা করে। পরীক্ষার দিনগুলিতে বেশ কিছু অতিরিক্ত লোকাল ট্রেন চালানোর ব্যবস্থাও করা হয়। এমনকি পরীক্ষার দিনগুলিতে রাস্তাঘাটে যানজট নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রশাসন পণ্যবাহী যানের উপর কিছু বিধি নিষেধ আরোপ করে যাতে পরীক্ষার্থীরা নির্বিঘ্নে পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছাতে পারে। এপ্রসঙ্গে পর্ষদ সভাপতি রামানুজ গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ❝ পুলিশ, প্রশাসন এবং পর্ষদ সব ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছে। পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছতে অসুবিধা হবে না। ❞
এতদসত্ত্বেও পরীক্ষার্থীদের অনেক সমস্যায় পড়তে দেখা যায়। পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে যাদের বাড়ি দূরে, বিশেষ করে যাদের পরীক্ষা কেন্দ্র পৌঁছতে খেয়া পারাপার করতে হয় তারা এই শীতের সকালে কুয়াশার মধ্যে নৌকা চলাচল নিয়ে আশঙ্কিত। নৌকা চলাচল দেরিতে শুরু হলে সঠিক সময়ে পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছতে পারবে না বলেও তারা জানায়। এই সমস্যার কারণে অনেক পরীক্ষার্থী পরীক্ষা কেন্দ্রের নিকটবর্তী আত্মীয়ের বাড়িতে থাকতে বাধ্য হয়।
মাধ্যমিক পরীক্ষায় বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে আরো একটি বিষয় লক্ষ্য করা যায়, তা হল প্রশ্ন ফাঁস। পরীক্ষার দিনগুলিতে পরীক্ষা শুরুর অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই প্রশ্নপত্রের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরতে দেখা যায়। এ বছরেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। যদিও এবছর প্রশ্ন ফাঁস রুখতে বিশেষ কড়া ব্যবস্থা গ্রহণ করে মধ্যশিক্ষা পর্ষদ। প্রতিটি প্রশ্নপত্রে আট অঙ্কের আলফা নিউমেরিক সিরিয়াল নম্বর ব্যবহার করা হয়। প্রশ্নপত্রের প্রতি পাতায় প্রতিটি প্রশ্নের পাশে কিউ আর (QR) কোড ছাপানো হয়। যাতে কেউ প্রশ্নপত্রের ছবি তুললেই সেখান থেকে সহজেই বোঝা যাবে কোন পরীক্ষার্থী এই ছবি তুলেছে। এছাড়াও প্রশ্ন ফাঁসে অভিযুক্ত পরীক্ষার্থীর সমস্ত পরীক্ষা বাতিল হবে বলেও জানানো হয়।
যদিও এতকিছুর পরেও প্রশ্ন ফাঁস আটকানো যায় নি। প্রথম পরীক্ষার দিনেই প্রশ্নপত্রের ছবি ফেসবুকে ঘুরতে দেখা যায়। মধ্যশিক্ষা পর্ষদের নজরে আসলে কিউ আর কোড স্ক্যান করে কোন পরীক্ষার্থী এই কাণ্ড করে তা ধরে ফেলে পর্ষদ। জানা যায় মালদা জেলার দুই স্কুল থেকে দুই পরীক্ষার্থী মোবাইলে ছবি তুলে বাইরে পাচার করে। ওই দুই পরীক্ষার্থীর মোবাইল বাজেয়াপ্ত করে প্রশাসন। পর্ষদ তাদের পরীক্ষাও বাতিল করে। যদিও প্রশ্ন ওঠে, এত কড়া নিরাপত্তা ও পদক্ষেপ গ্রহণের পরেও কোনো পরীক্ষার্থী মোবাইল নিয়ে পরীক্ষা কেন্দ্রে কিভাবে প্রবেশ করে? দ্বিতীয় পরীক্ষার দিনেও প্রশ্ন ফাঁস ঘটানোর ব্যতিক্রম দেখা যায়নি। এবার কিউ আর কোড লাল কালি দিয়ে কেটে তারপর ছবি তুলে পাচার করা হয়। তাতেও শেষ রক্ষা হয় নি ওই পরীক্ষার্থীদের। লাল কালি মুছেই মালদা জেলার এনায়েতপুর হাই স্কুলের ৬ জন পরীক্ষার্থীকে চিহ্নিত করে পর্ষদ। তাদের সকলের পরীক্ষা বাতিল করা হয়। এই ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে পর্ষদ। প্রশ্ন আসে, প্রশ্নপত্র ফাঁসে কোনো পরীক্ষার্থী কি লাভবান হয়? হয় না। তাহলে কেন এই প্রশ্ন ফাঁস? পরীক্ষা বিঘ্নিত করে বোর্ডকে বিপদে ফেলা এবং প্রশাসন ও সরকারকে কালিমালিপ্ত করায় এর প্রধান উদ্দেশ্য। তৃতীয় দিনেও প্রশ্ন পাচার বন্ধ না হওয়ায় পুলিশ প্রশাসন কড়া পদক্ষেপ গ্রহণ করে। বাজেয়াপ্ত মোবাইলগুলি থেকে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের সন্ধান পায় প্রশাসন। 'এম পি ২০২৪ কোশ্চেন আউট' নামে ওই গ্রুপের বেশ কয়েকজন অ্যাডমিনের মধ্যে জীবন দাস নামে এক গৃহশিক্ষককে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরীক্ষা পর্ব শেষ হলে শিক্ষা মন্ত্রী ও পর্ষদ সভাপতির যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে শিক্ষা মন্ত্রী জানান, সাইবার অপরাধীদের একটা চক্র এই সব কাণ্ডের পেছনে রয়েছে। যারা টাকার বিনিময়ে এসব করে থাকে। তিনি আরো জানান, এবছর ৩৬ জনের পরীক্ষা বাতিল করেছে মধ্যশিক্ষা পর্ষদ। পর্ষদ সভাপতি জানান, মালদা জেলা থেকেই ২৩ জনের পরীক্ষা বাতিল হয় এবং ৩৬ টি মোবাইল ফোন বাজেয়াপ্ত করা হয়।
প্রসঙ্গত, কেন্দ্রীয় সরকার ২০২০ সালে যুগ্ম তালিকায় থাকা শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে রাজ্যগুলির সঙ্গে আলাচনা ছাড়াই জাতীয় শিক্ষানীতি (National Education Policy) চালু করে। এর মাধ্যমে বিগত কিছু বছর ধরে একটি নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার জন্য চেষ্টা করছে। এই শিক্ষানীতিতে ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার কাঠামোয় আমূল পরিবর্তন আনা হয়। এই জাতীয় শিক্ষানীতির মাধ্যমে পুরো দেশের সকল ছাত্রছাত্রীদের মাধ্যমিক (10th Standard) পরীক্ষাকে ঐচ্ছিক ঘোষণা করা হয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার এই শিক্ষানীতির পুরোপুরি মানতে নারাজ। তাই রাজ্য সরকার এ রাজ্যের জন্য নতুন শিক্ষানীতি আনে, যাতে মাধ্যমিক পরীক্ষা যথা নিয়মিত হবে বলে জানায়। পশ্চিমবঙ্গে পাশ ফেল প্রথা উঠে যাওয়াই শিক্ষাব্যবস্থায় যে বিরূপ প্রভাব পড়েছে তা অস্বীকার করা যায় না। এমতাবস্থায় মাধ্যমিক পরীক্ষা উঠিয়ে দিলে মধ্যে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে পঠন-পাঠনের যে অনীহা সৃষ্টি হবে তা বলাই বাহুল্য। তাই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মাধ্যমিক পরীক্ষা নিয়মিত নেওয়ার সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাতে হয়।
- দ্বি-মাসিক পত্রিকা -
সম্পাদক: মোঃ আযাদ হোসেন
গ্রাহক পরিষেবা: রনিক পারভেজ, ৯৩৭৮৪৮০১৯১
পাণ্ডুলিপি (ম্যানুস্ক্রিপ্ট) প্রস্তুতি ও সম্পাদনা : মোঃ মিনারুল হক
নামলিপি ও প্রচ্ছদ চিত্র: হিমাদ্রী শেখর মজুমদার
সত্বাধিকার: ভয়েস মার্ক কালচারাল গ্রূপ
RNI Ref. Number: 1343240
সম্পাদকীয় দপ্তর:
ভগবানপুর , আষাঢ়িয়াদহ
লালগোলা, মুর্শিদাবাদ
পিন - ৭৪২১৪৮
azadm.1981@gmail.com, voicemark19@gmail.com